Tanmoy M Dey Biswas er deyal theke.....


আন্তর্জাতিক মাতৃদিবসের শুভেচ্ছা-


মেয়েটির নাম, পারুলবালা হেমব্রম।
বয়স পঁচিশ। রঙ কালো, বেশ গোলগাল, একটু বেঁটে,
আর পাঁচটা আদিবাসী খেটে খাওয়া মেয়েদের মতোই চেহারা।
তবে শরীরের সঠিক জায়গায় মেদটা একটু বেশি।
ইঁটভাঁটার কামিন। বাবুদের সস্তার চাহিদা মেটানোর খাদ‍্য।
অন্য আর পাঁচটা মেয়েদের থেকে তফাৎ একটাই,
মেয়েটা জেদি, মনের জোর আর পাঁচটা মেয়ের থেকে অনেক বেশী।


একদিন দুপুরে, সকালের ফুরনের ইঁট কেটে নিজের ঘরে আসে পারুল। আজ সকাল থেকেই তার মাথাটা বড্ড ঘুরছে।
ক্ষিদে নেই, খাবার আগ্ৰহটা একদম চলে গেছে।
অন‍্যদিনে এই সময়ে পেটের মধ্যে আগুন জ্বলে
তেললঙ্কা পান্তা আর পিঁয়াজ দিয়ে পেটপুরে খায় পারুল,
আজ দুগাল মুখে তুলতেই গা গুলিয়ে ওঠে
সকাল থেকে পেটের মধ্যে জমেথাকা পিত্তি, পান্তার সঙ্গে উঠে আসে গলগল করে- বমি করে পারুল।
গোটা শরীর টা অবশ হয়ে আসে, দাঁড়ানোর ক্ষমতা টুকুও যেন হারিয়ে ফেলে।
ছুটে আসে পাশের চালার নাগা র মা, অর্জুনের বৌ, সুধা বুড়ি।
ওরা বুঝতে পারে, পারুলের কি হয়েছে
এ বমি সাধারণ বমি নয়
এ বমি শুধু পোয়াতি মেয়েদের ই হয়
চোখ চাওয়া চাওয়ি করে সবাই
পারুল যে পোয়াতি !
আইবুড়ো ছুঁড়ি, আজ পোয়াতি মাগী!


ডাক পড়ে গ্ৰামের সিধু ডাক্তার এর
সিধু ডাক্তার বলে যায় - পারুল অন্তসত্ত্বা, তিন মাস
সবাই মিলে ঘিরে ধরে পারুলকে-
ভল পারুল, কে সেই মদ্দা, একবার নামটা বল
নিশ্চুপ পারুল, কোনো কথা নেই তার মুখে
কোনো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, নালিশ নেই
দোরের পাশে একটা থলের ওপর শুয়ে আছে পারুল
নিশ্চুপ, নির্বাক, আগামী তে কল্পনা সঁপে দিয়ে।


আপনারা যারা ভদ্রলোকের মতো- দয়া করে পারুল কে দোষ দেবেন না। ওর চরিত্রে কোনো কলঙ্ক দেবেন না। একটা সাধারণ মেয়ে, আপনার আমার ঘরে যেমন আছে, তেমন ই একটা মেয়ে একজন কে ভালোবেসেছিল, উজাড় করে দিয়েছিল তার ভালোবাসা । কোনো সন্দেহ ছিল না তার ভালোবাসার নাগরের প্রতি। আপনারা দয়া করে পারুল কে অসতী বলবেন না।


বিচার বসে। একটা আইবুড়ো মেয়ের পোয়াতি হবার বিচার,
উপচে পড়ে গোটা আদিবাসী সমাজ
মোড়ল বিধান দেয়-
বাচ্ছাটাকে পারুলের শরীর থেকে উপড়ে ফেলার,
রাজি হয়না পারুল। কি দোষ এই বাচ্ছার?
সেতো কোনো অন‍্যায় করেনি,
আর পাঁচটা নারী পুরুষের ভালোবাসার মতোই এটাও তো ভালোবাসার দান, প্রেমের ফসল,


ভদ্রমহোদয়গণ, পারুলের দোষ দেখবেন না।
আপনাদের ঘরের এক সদ‍্য অন্তসত্ত্বা মায়ের কথা ভাবুন,
তার মা হবার আনন্দের কথা ভাবুন
পরিবারের সকলের তার প্রতি সম্মানের, ভালোবাসার কথা ভাবুন।
একটা আদিবাসী মেয়ে একজন কে ভালোবেসে ছিল
একটা আদিবাসী মেয়ে একটা ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল
একটা আদিবাসী মেয়ে, মা হতে চেয়েছিল,
আর যাই হোক, তাকে চরিত্রহীনা বলবেন না
তার চরিত্র আপনার ঘরের আর পাঁচটা মেয়ের থেকে কম গর্বের নয়,


মোড়ল দ্বিতীয় বিধান দেয়-
পঞ্চাশ ঘা জুতো মেরে গ্ৰাম থেকে সমাজ থেকে চির নির্বাসন,
কান্নায় ভেঙে পড়ে পারুলের বুড়ো বাপ মা।


--- হামার মাইয়ার দুষ টা কুথ্থায় রে মোড়ল ?
উ তো একজন কে ভালো বেইসেছিলো। সেই হারামির পোলা যদ্দি উয়ার সব্বনাশটু করে, তাইলে ছুকরাটাকে বুলানা কেনে !
হামার মাইয়াটারে শাস্তি দিচছিস কেনে ? এই পারুল, সেই হারামজাদা টার নামটা সবার সামনে বুলনারে মা। সুব্বাই তার বিচার টু আগ্গে কুরুক।


আবার নিশ্চুপ নির্বাক পারুল। তা ভালোবাসা র লোক যদি পালিয়ে যায়, স্বেচ্ছায় তাকে গ্ৰহণ না করে, পিতৃত্ব স্বীকার না করে, তাহলে কোনদিন ই তার নাম বলবেনা পারুল।
একজন মেয়ে হয়ে, এই আত্মসম্মানবোধ টুকু তার আছে।


ভদ্রমহোদয়গণ- পারুলবালা আদিবাসী অশিক্ষিত একটা মেয়ে হতে পারে, কিন্তু তার অভিমান, আত্মসম্মানবোধ আর পাঁচটা শিক্ষিতা আধুনিকা মেয়ের থেকে কোনো অংশে কম নয়।
দয়া করে তাকে আপনারা কুলোঠা বলবেন না।


শেষবারের মতো বিচারের রায় দেয় মোড়ল -


মোড়লের পছন্দ মতো পাঁচজন বিবাহিত পুরুষ ভোগ করবে পারুলবালা র শরীর।


নিথর নির্বাক পারুলবালা চেয়ে থাকে উদাস চোখে মাটির দিকে। এটাই ছিল তার নিয়তি। তবু নিজের সন্তানের কথা ভেবে চুপ করে থাকে পারুলবালা।


একদিন সেই দিনটা আসে-
পাশবিক উল্লাশে একজন একজন করে ভোগ করে পারুলবালা র শরীর। এতদিন যাদের কাকা, জ‍্যাঠা , মামা , মেসো বলে ডাকতো , তারাই আজ জল্লাদের মতো সব সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে দন্ড প্রদান করে পারুলবালা কে। পারুলবালা আজ আর কারো মেয়ে নয়, কারো বোন নয়। পারুলবালা আজ শুধুমাত্র একটা নারী, একজন কুমারী মা।


এবার ভদ্রোমহোদয়গণ ?
কি বলবেন ? কোন চোখে দেখবেন এই ত‍্যাগ ?
মেনে নিতে পারবেন ,কোনো কুমারী মায়ের এই আত্মবলি?
এরপর দয়া করে তাকে অন্তত বেশ‍্যা বলবেন না।


ধীরে ধীরে মাতৃত্বের সব লক্ষ‍্যণ প্রকাশ পেতে থাকে পারুলবালা র শরীরে। নিজের মনে নিজের গর্ভস্থ আত্মজের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে কোথায় হারিয়ে যায় পারুল। কখনো হাসে, কখনো বা বিড়বিড় করে কথা বলে তার সম্ভাব্য সন্তানের সঙ্গে।
পারুলের বৃদ্ধ বাবা মা সাধ‍্যমতো পথ‍্য দিয়ে যায় পারুলবালার খাবার হিসেবে। কোনোদিন কোনোভাবেই পারুলবালা কে ভর্ৎসনা করেনি তার বাবা মা। হাজার হলেও সন্তান তো !


অবশেষে সেই বিশেষ দিনটি আসে।
আজ আর হাত পা নড়ছে না পারুলের।
সকাল থেকে পেটের বাচ্ছাটা বেরিয়ে আসতে চাইছে,
অসহ্য যন্ত্রণা-
সন্ধ‍্যাবেলায় জল ভাঙে পারুলবালা র
নবজাতকের জন্ম আসন্ন
কোনো পুরুষ নেই কাছেপিঠে-
জল্লাদ পুরুষ গুলোর স্ত্রী রা ছুটে আসে পারুলের কষ্ট দেখে
হাজার হলেও, তারা বোঝে বাচ্ছা বিহানোর কষ্ট-
তারাও তো মা-


ডাক পড়ে সিধু ডাক্তারের-
একটু ও সময় নষ্ট না করে ছুটে আসে ডাক্তার
অর্জুনের বৌ নিয়ে আসে গরম জল
নাগা র মা , সুধা বুড়ি সবাই অপেক্ষা করে নবজাতকের জন্যে,


কিছুক্ষণ পর, কেঁদে ওঠে শিশু
পুত্র সন্তান প্রসব করেছে পারুলবালা,
সুন্দর ফুটফুটে ধবধবে ছেলে,
সবাই বলে, ওর বাপ বোধহয় খুব ফরসা, তাই নারে পারুল ?
দু চোয়াল চেপে, কঠিন চোখে ঘাড় নাড়ে পারুল।


ভদ্রোমহোদয়গণ, আধুনিকা মা বোনেরা-


অনেক নামিদামি ডাক্তার, দামি দামি ওষুধ পত্র, নামকরা হাসপাতাল নার্সিংহোমে র ঠান্ডা কেবিনে আপনারা যন্ত্রণা বিহীন মাতৃত্ব লাভকরেন। আপনাদের অভিভাবক রা পরিচর্যায় ভালোবাসায় আবাহন করেন আপনাদের মাতৃত্ব। আপনাদের জন্যে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃদিবস।


একটা আদিবাসী অশিক্ষিতা মেয়ে ভালোবেসেছিলো, নিজের সর্বস্ব উজাড় করে সুখ দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল তার প্রেমিক কে। কুমারী অবস্থায় মাতৃত্ব গ্রাস করেছিল তাকে। অস্বীকার করেনি সে মাতৃত্ব। অনেক কষ্ট অনেক অন‍্যায় অনেক যন্ত্রণা সহ‍্য করে সে জন্ম দিয়েছে তার ভালোবাসার উপহার পাওয়া সন্তান কে। জানি মা হওয়া অনেক কষ্ট, অনেক সাধনা।
একটা আদিবাসী কুমারী মেয়ের মা হওয়া আরো আরো কষ্টের, আরো যন্ত্রণা র আরো দায়িত্বে র।


ধীরে ধীরে উঠে বসে পারুলবালা,
কোলে তুলে নিয়ে আদর করে তার নবজাতক সন্তান কে।
এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে , অসাম‍্য লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে পারুলবালা।


অর্জুনের বৌ বলে ওঠে --


--- ছেলের কি নাম দেবে গো ঠাকুরঝি ?


সিধু ডাক্তার বলে ওঠে --- ছেলেটার নাম দিলাম, " কর্ণ "