কর্মসূত্রে একবার বহরমপুর গিয়েছিলাম। সেটা ছিলো রথের দিন । বহরমপুরের অদূরে একটি গ্ৰামের রথের মেলায় একটি গরীব ছোট্ট মেয়েকে দেখে, আমার এই কবিতা -


*** উল্টোরথ ***
                        তন্ময় দে বিশ্বাস


রথেরমেলা রথেরমেলা রথতলা গমগম
সকাল থেকে ঘরের কাজে বসছে নাকো মন,
রথতলাতে বাজছে মাইক, লোক জমেছে কত-
পারুলবালা মেলায় যাবে, আর সকলের মতো,


পারুলবালা গ্ৰামের মেয়ে- বয়েস যে তার আট,
এই বয়েসেই সামলাতে হয়, সংসার রাজপাট!
কুটনোকোটা, বাটনাবাঁটা, রান্না, বাসনমাজা -
উঠোন ঝাঁটা, ঘর নিকনো, কাপড় জামা কাচা,
এমনি করেই দিন কাটে তার - নেইকো অবসর,
তার ওপরে উপরি জোটে - মাতাল বাবার চড়!
দিদির কোলে ছোট্ট দুভাই, বয়স পাঁচ আর তিন-
সবার ছোটো মায়ের কোলে, মাত্র ছ সাত দিন,
এদের নিয়েই পারুলবালার , ভরাভর্তি ঘর-
গিন্নি এখন পারুলবালা - নেইকো অবসর ।


বাজছে মেলায় ভেঁপু বাঁশি, মন করে আনচান-
সকাল সকাল পাট চুকিয়ে, মেলায় যাবার টান -
বানিয়েছে মাটির ঘোড়া- বেচলে যেটা পাবে,
আনবে কিনে বাদাম পাঁপড়- সবাই মিলে খাবে!
এই আশাতেই সকাল সকাল সাঙ্গ করে কাজ -
চুল বাঁধে আর কাজল পরে, মেলায় যাবার সাজ,
হাতে নিয়ে মাটির ঘোড়া- হনহনিয়ে ছোটে -
হে ভগবান - একটা ভালো খদ্দের যেন জোটে -


মেলার মাঠে এক কোনেতে সাজিয়ে আপন ডালা,
চুপটি করে অপেক্ষা তার - কিনতে আসার পালা,
আসছে কত, দেখছে সবাই- তাকায় মুখের পানে-
সুধোয় না কেউ দামটা কত- কিনবে কে তা জানে !
গাঁটের কড়ি নেই কিছু তার, শুধুই মেলায় আসা -
বিকোয় যদি তার সে ঘোড়া, মিটবে তবেই আশা-
কিনছে সবাই খেলনা পুতুল - ঘুরছে নাগরদোলা-
চুপটি করে পারুলবালা, দেখছে সকল খেলা !


সূয্যি ডোবে ভাঙছে মেলা, সন্ধ‍্যা ঘনায় আসে-
উদাস মনে পারুলবালা- দুচোখ জলে ভাসে -
স্বপ্ন ছিলো চোখের কোনে , ফিরবে ছুটে বাড়ী -
নিশ্চই কেউ কিনবে ঘোড়া , মিলবে দুটো কড়ি -
কিনবে কিছু খেলনা খাবার , তালের পাতার বাঁশী-
দুচোখ ভরে দেখবে ভায়ের , প্রাণ ভরানো হাসি ,


স্বপ্ন কি তার মিলিয়ে যাবে - আর কিছুটা পরে ?
ফিরতে হবে শূন্য হাতে - তার সে মাটির ঘরে !
আসবে ছুটে ছোট্ট দুভাই - দিদির কাছে আশায় -
করবে সেকি -বলবে কিসে -আসছে নাকো মাথায়,
ধীরে ধীরে কমছে মানুষ - ভাঙছে রথের মেলা -
দূরের পথে ভেঁপু বাজে - ঘরে ফেরার পালা -
ছোট্ট দুহাত বোলায় পারুল -মাটির ঘোড়ার মাথে-
মিললো নাকো একটা কড়ি- ফিরবে খালি হাতে !


এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি " কতো হলে দেবে ?"
ঝকমকিয়ে বলে পারুল " বাবু - তুমি নেবে ?
দাওনা বাবু যা ইচ্ছে তাই - নিজের হাতে গড়া -
খুব মানাবে তোমার বাড়ী - আমার মাটির ঘোড়া "


পাঁচটা টাকা দিলাম গুঁজে পারুলবালার হাতে,
অবাক হয়ে করলো প্রণাম - রাখলাম হাত মাথে,
মুখভরা তার হাসিখানা - অমূল্য তার মজা -
পাঁচটা টাকায় নিলাম কিনে - আমি এখন রাজা!
এক দৌড়ে পারুলবালা- হারিয়ে গেলো ভিড়ে ,
ঘরের পথে পা বাড়ালাম - আস্তে ধীরে ধীরে !


এ জগতে যাদের সাথে , নিত্য ওঠা বসা -
আকাশ ছোঁয়া বাসনা আর , মুখোশ পরে মেশা !
গ্ৰামের মেয়ে ছোট্ট পারুল , ঐ টুকুতেই খুশি -
"হে ভগবান" কেড়োনা ঐ সরল মুখের হাসি !
প্রতি গ্ৰামে এমন পারুল , হাজার হাজার আছে ,
চিনে নিও তোমরা তাদের , ডেকে নিও কাছে ,
বুঝবে সেদিন রাজা হওয়ার আনন্দটা কি সে !
এমন পারুল আছে বলেই - রথের মেলা বসে ।।