শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ'লো তার সাধ;


কবিতার শিল্প সৃষ্টির মধ্যে ছন্নছাড়া ক্ষ্যাপামির একটা জোর জবরদখল আছে।  বিশ্বের যিনি স্রষ্টা তিনি তার এক কণা ভালোবাসা সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দিলেন, তাই দিয়ে আমরা ক্ষ্যাপা এই জীবনকে ভালোবাসি, ভালোবাসি শিল্প, কবিতা, সংগীত, অমর অজেয় সব প্রেমের আখ্যান।  জগতে কারো জন্যে কিছু থেমে থাকেনা, এটাও যেমন সত্যি , মানুষই মানুষকে বাঁচিয়ে তোলে , আনন্দের জগতে, নিখাদ ভালোবাসায় এটাও তেমনি এক ধ্রুব সত্য।


মৌনতার একটা নীরব ভাষা আছে।  তাকে খুব বেশি ঘাঁটাতে নেই।  নিরুচ্চার তবু বাঙময় তার উচ্চারণ | ছায়ার গাঢ় অন্ধকারে মিশে যাবার পূর্বে কায়া ময় অস্তিত্ব প্রশ্ন করে নিজেকে ,
জীবন যে আমায় বহন করে চলেছে , সে কি সত্যি আমি? যে আমি সূর্যাস্তের রং জলের ওপরে দেখতে ভালোবাসি, সে আমিই তো শান্ত ঠাণ্ডা কণ্ঠে আবেগের বাছবিচার করি , সত্য মিথ্যের গোত্র নির্ণয় করি।  মানুষ কতখানি অসহায় বাস্তবের কাছে? নাকি আদত বাস্তবতাই মানুষের  ব্যক্তিগত সত্যের যে ব্যাখ্যা, তার সাথে পথ চলে ?


তুমি আমাকে বলছিলে, ভালোবাসায়  পাপ নেই। ভালোবাসা আকাশের মতো মুক্ত।  তাতে  কালিমা লাগেনা।  তা প্রকৃতির মতোই নির্মল। আমার মুখে কথা যোগায় নি।  আমি নির্বাক নিস্তব্ধ ভাবেই তোমার কথা শুনছিলাম।  আমি তোমার প্রাক্তন প্রেম , তোমার বর্তমানের চাবিকাঠি আমার কাছে নেই।  তবে আমি তোমায় মিথ্যে কথা বলতে দেখিনি কখনো।  টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে তুমি আমি আপ্লুত হতাম , সেই আমি তুমি আজ হিসেব কষি আমাদের সন্তানেরা মাসের কোনদিন কোথায় থাকবে , আমাদের অতীত সম্পর্কের  ভাঙাগড়া ওদের যেন এতটুকুও স্পর্শ না করে।  এটাও শিখছি ধীরে ধীরে , জগতে শেখার শেষ নেই।


আমি তোমায় প্রশ্ন করতে পারিনি  অথচ হাজারটা প্রশ্ন তৈরী ছিল মনের মাঝে।  আমাদের যে অতীত , তা কি আমাদের বর্তমান কে ছাপিয়ে তোলে?  বর্তমানটিও তো নিজস্ব নিয়মের সত্য তৈরী করে চলেছে , সেখানটায় জোড়াতালি দিলে , তার দায়ভার কি কোথাও দেবার নেই ?


রাতে মাঝেমাঝে অকারণেই ঘুম ভেঙে যায়।  এতদিন যে বাস্তবতাকে লালন করে জীবনের সংজ্ঞা খুঁজে পেতে চেয়েছিলাম, তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে সময়ের প্রয়োজনে।  নতুন করে তবুও পথ চলার শক্তি খুঁজি এই জীবনের কাছেই, কবিতার প্রতিটি শব্দের উচ্চারণে, তার শরীরের গন্ধে, স্বাদে।


সেখানটাতেই আমি আছি, তুমি আছো, আমাদের সন্তানদের শৈশব আছে।  আর আছে সেই অমোঘ কবিতার অস্তিত্ব।  সেকি আশীর্বাদ না অভিশাপ , তা আমি আর বুঝতে চাইনি , পারবোনা বলে তাই।  মঙ্গলময় ঈশ্বর যেন শান্তি দেন, তোমায় ভালোবাসায় পূর্ণ রাখেন বর্তমানে, আর অতীতের একটা যথোপযুক্ত সদ্গতি করিয়ে দেন।  আমি চললাম সেই কবিতার বোধটুকুকে সম্বল করে , তার চাইতে বড়ো সত্য যে আমার কাছে আর কিছু নেই !


জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্ত—ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ'য়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে।


(আট বছর আগের একদিন : জীবনানন্দ দাস )