। অশ্ব নামের হস্তী।


‘অশ্ব! দাঁড়া স্থির হয়ে , পিঠ ডলে দিই ঠিকঠাক!’
নদীতীর থেকে ভাসে স্নেহের ধমক, সাথে গুরু বৃংহণডাক।
অশ্ব ও বৃংহণ? ভারী কৌতুকপ্রদ! কিঞ্চিৎ চমকিত মধ্যম পাণ্ডব,
এসেছিলেন তিনি কিছুটা সময় কাটাতে নিজের সাথে, অদূরেই সেনা কলরব,
সাত অক্ষৌহিনী ভিড়ে কান পাতা দায়। শুধু হ্রেষা বৃংহণ আর মানুষের চিৎকার,
আর কটাদিন পরে  একাদশী তিথি, যুদ্ধের শুরু। জোর তোড়জোড় চলে দুপক্ষে তার।


তিনি মহাবলী ভীম, একশো ধার্তরাষ্ট্র নিধন শপথ নেওয়া দ্রৌপদীনাথ,
লোকে ভাবে সর্বদা যুদ্ধং দেহি তিনি। সর্বদা গদাঘাতে উদ্যত হাত,
জিজ্ঞাসু মন নিয়ে জীবনতত্ত্বকথা ভাববার একেবারে উপযুক্ত নন ,
অথচ জানেনা কেউ, রোজের ভ্রমণে করা প্রকৃতি ও মনুষ্য অধ্যয়ণ,
পুঁথি নয়, মানুষ আর পৃথিবীই দিতে পারে যথার্থ জীবনের বোধ,
সে বিশ্বাসে এ অভ্যেস তাঁর।কিন্তু বেদব্যাস শ্লোকে ফোটান শুধু ক্রোধ,
সেখানে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জ্ঞানে উজ্জ্বল। আজ প্রত্যুষে ছেড়ে সেনাকোলাহল,
জাহ্নবীতটে সেই প্রকৃতিপঠনকালে শুনতে পেলেন বৃকোদর,
অশ্ব সম্বোধন করে কেউ পোষ্যকে, অথচ যাচ্ছে শোনা হস্তীর স্বর।
একটু এগোতেই দেখা গেলো তাকে, ঐরাবতপ্রমাণ এক মহারণ-গজ,
করাচ্ছে স্নান তাকে সযত্নে মাহুত, অনতিদূরেই খুলে রাখা আছে ধ্বজ,
আর বারংবার ধমকে উঠছে হাতি মৃদু নড়লেই। ‘ স্থির হয়ে দাঁড়া না অশ্ব!’
ভীমকে দেখে শশব্যস্ত প্রণাম জানালো সে। শুঁড় তুলে অভিবাদন জানালো পোষ্য,
মাহুতের প্রভু মানে সে মানুষ তারও মালিক। হেসে বললেন কুন্তীসূত,
‘হস্তীকে অশ্ব ডাকো কেন?’ এমন প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললো মাহুতও,
তারপর বললো ‘ প্রভু, এর নাম অশ্বত্থামা। সেই নাম আচার্য দ্রোণের পুত্রেরও
পুরোটা বলা তাই নয় সমীচিন। তাই এই হস্তীতে অশ্বের গেরো।
হো হো করে হেসে উঠে  হিড়িম্বাপ্রিয়, হাতিটির শুঁড়ে দেন স্নেহের আদর,
তারপর থেকে, রোজই দেখা হতো যুগলের সাথে। কুরুক্ষেত্র শুরু হলো অতঃপর।


ভীষ্মের পতনের পরে, দ্রোণ সেনাপতি। তিনি মহাদুর্মদ যোদ্ধা, অজেয় দেবতারও,
অস্ত্র থাকলে হাতে মারতে পারবে না কেউ। শিবিরে হতাশা ছেয়ে গাঢ়,
স্বয়ং অর্জুন অপারগ যে কাজে, তাঁকে বধ করা যাবে কোন অলৌকিকে?
স্বাভাবিক, সমস্ত সমস্যার শেষ সমাধান যিনি, সকলেই চান সেই কৃষ্ণের দিকে।
দ্বারকাধিপতিও  চিন্তিত খুব। অবশেষে বললেন, কন্ঠে মহাকালের অমোঘতা,
‘অস্ত্র থাকলে হাতে আচার্য অজেয়। শোনাতে হবে তাঁকে তাঁর পুত্রের মৃত্যুর কথা।’
‘দ্রোণপুত্র.. মানে অশ্বত্থামা? তার মৃত্যু হতে পারে নাকি, তিনি তো অমর!’
কৃষ্ণ বলেন ‘জানি। তবু যুদ্ধের উত্তেজনা তা ভোলাবে, বাপের হৃদয় বড় স্নেহনির্ভর।
তবু তিনি যাচাই করবেন নিশ্চিত। বিপক্ষে সত্যে যিনি আজীবন স্থির,
উত্তর চাইবেন আচার্য তাঁর থেকে ঠিক ।আপনাকে মিথ্যা বলতে হবে যুধিষ্ঠির।’
‘ অসম্ভব, বাসুদেব!’ কাতরে উঠলেন প্রথম পাণ্ডব, ধর্মের চিরঅনুসারী,
মিথ্যা বলতে আমি পারবো না । যত কেন যুদ্ধতে হারি,
সত্যের পথ আমি ত্যাগ করবো না কেশব। এ ভয়ঙ্কর অনুরোধ কোরো না আমায়!
হাসলেন দেবকীনন্দন। ‘ হে জ্যেষ্ঠ, পুরো মিথ্যা নয়। সর্প বিনষ্ট করে যষ্ঠী অক্ষত রাখার রয়েছে উপায়।’


উপায় শুনে শিউরে উঠলেন ভীমসেন! হাতিটি যে হয়ে গেছে তাঁর বড় প্রিয় ,
রোজ তার ছোটোখাটো কুস্তির সাথী। অথচ উপায় আর নেই একটিও,
যুদ্ধের বালাই বড় কঠিন বাস্তব। বিষণ্ণ  মহাবীর অগ্রসর হলেন হস্তিশালাতে,
আগেই নির্দেশ পেয়ে সে মহাকরীর পায়ে পড়েছে শেকল।ভীম ঢুকলেন গদা হাতে,
প্রিয় মানুষটিকে দেখে শুঁড় তুলে অভিবাদন জানালো অশ্বত্থামা। কেন তাকে রাখা আছে বেঁধে,
সে অভিযোগও হয়তো বা করলো সে মৃদু বৃংহণে। মাহুত বেরিয়ে গেছে হাউ হাউ কেঁদে,
মধ্যম পাণ্ডব একা। হাতি তার সাথী দেখে একটু আদর চায়, এর থেকে নেই কোনো ভয়..
তখনই মৃত্যু নামে গদার আঘাতে। খুলি ফেটে মরে যেতে যেতে,
দুই চোখে ভরে বিস্ময়,
রণহস্তীটি শুধু ভীমকেই দেখে। দু চোখ গড়িয়ে নামে জল, শিকার ও ঘাতকের উভয়ত।


উন্মাদের মতো চিৎকার করতে থাকেন তৃতীয় কৌন্তেয়। ‘ আমার হাতে অশ্বত্থামা হত! অশ্বত্থামা হত!’
পরের ঘটনাবলী সকলেরই জানা। যুধিষ্ঠিরের সেই ‘ অশ্বত্থামা হত.. ইতি নরোবা কুঞ্জবাঃ...’
ভীমের দুঃখকথা লেখেন নি ব্যাসমুনি। সিংহাসনের গল্পে পায়না তা শোভা।


আজও কি মরে কোনো অশ্বত্থামা হাতি নিজের লোকের আঘাতে?
কে জানে, হয়তো বা..


আর্যতীর্থ