। মুষলপর্ব।


তিনি দেখছেন অসহায় হয়ে,
ঝগড়া করছে কৃতবর্মা আর সাত্যকি।
এই কিছুক্ষণ আগেও দুজনে একসাথে বসে মদ খেয়েছে,
তারপরই অকস্মাৎ অতীতের ভুল নিয়ে মারামারি বেঁধে গেছে।
তিনি দেখছেন,
ঝগড়া করছে নাসির আলি আর পরান মণ্ডল,
আহ, না না, ওরা  তো সতবির সিং আর মীর মহম্মদ!
ওই তো ছুটে যাচ্ছে প্রদ্যুম্ন ,
সাত্যকি মাথা কেটে দিলো কৃতবর্মার,
তিনি দেখছেন, কমল বসাকের বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে আমজাদ শেখ,
আমজাদের মাথায় তরোয়ালের কোপ বসালো হিম্মত সিং।
প্রদ্যুম্ন , তাঁর প্রিয় পুত্র , কৃতবর্মার বন্ধুর হাতে ওই তো নিহত..
তিনি শুনছেন, গণেশের মা আর আব্দুলের আম্মির কান্নার আর্তনাদ,
কি আশ্চর্য ,
শোকের স্বরে বা শব্দে কোনো তফাত নেই।


তিনি দেখছেন,
যাদবেরা এক এক করে তুলে নিচ্ছে শরকাঠি,
আর মুহূর্তে সেটা মুষল হয়ে যাচ্ছে,
মুষল হয়ে যাচ্ছে গৌরহরির হাত-দা,
আজমলের গাঁইতি, সতবন্তের শাবল,
চারদিকে জ্বলে উঠছে আগুন,
দাউ দাউ করে পুড়ে যাচ্ছে দ্বারকা,
জ্বলছে হিন্দুর বাড়ি, পুড়ছে মুসলমানের ঘর,
তিনি শুনছেন
বাতাস কান চাপছে গণধর্ষিতা হিন্দু মুসলিম শিখ মেয়েদের ছিঁড়ে যাওয়ার চিৎকারে,
আহ দারুক, প্রিয় সারথী আমার,
যাও এ খবর নিয়ে অর্জুনের কাছে,
যাদবরমণী আর নিরাপদ নয় ।


তাঁর হাত থেকে উধাও হয়ে গেছে সুদর্শন চক্র ,
নিখোঁজ হয়েছে পাঞ্চজন্য,
অসহায় বিষাদে তিনি শুধু দেখতে পারেন এই স্বজনঘাতী সংগ্রাম। তিনি দেখছেন,
অন্ধকেরা অনেকে মিলে ঘিরে ফেলেছে কয়েকজন বৃষ্ণিকে,
তাদের হিংস্র উল্লাসে শুধু শোনা যাচ্ছে
মার কাফেরগুলোরে,
মার কাটার বাচ্চাদের,
পাগড়ি খুলে টায়ারে জ্বালা পাঁইয়া শালাদের,
মার মার মার...
চারদিকে মুষলের আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে চেনা যাদবদের লাশ, অন্ধক, বৃষ্ণি, কুকুর, ভোজ..
কোনো তফাৎ নেই মৃত্যুতে।


    প্রিয় বলরাম, কোথায় তুমি?
রক্তের কাদা মাখা জন্মের ভূমি,
এসময় কোথায় লুকালে সংকর্ষণ?
অন্তত উপক্রমণিকা শোনাও,
‘ We, the people of India’..
তিনি খুঁজছেন, কৌরব পান্ডব সমান ভাবা বলভদ্রকে,
নিরপেক্ষতা যার আজীবন সম্পদ,
পাতায় পাতায় লেখা নাগরিক শান্তি ও শৃঙ্খলা রাখার উপায়, কোথায় তুমি সেকুলার সংবিধান?
মৃত মানুষের স্তুপের অন্ধকারে, দিব্যদৃষ্টিতে তিনি দেখলেন,
ধর্মনিরপেক্ষতা দেহত্যাগ করছেন,
আর তাঁর নাসারন্ধ্র থেকে বেরিয়ে আসছে সহস্র ফণার এক বিষধর সাপ,
যার প্রতিটি  ছোবলে আগামী জর্জরিত হবে।


   হঠাৎই একটা তির লাগলো তাঁর পায়ে।
তিরই তো, নাকি ওটা বুলেট? তিনি বুঝতে পারেননা,
শুধু দেখেন রক্ত ছিটকিয়ে তাঁর বসন ভিজিয়ে দিচ্ছে।
ঘোলাটে হয়ে আসা দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পান,
তাঁর স্বভূমি তলিয়ে যাচ্ছে যুক্তিবিহীন অথই হিংসার সমু্দ্রে।
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আততায়ীকে দেখেন।
কে তুমি , হত্যাকারী ব্যাধ? জরা, না নাথুরাম?


     জন্মভূমির বাতাস শেষবার ফুসফুসে নিয়ে তিনি অস্ফুটে উচ্চারণ করেন  ‘ হে রাম!’


আর্যতীর্থ