তোমার চলে যাবার দিনে
বহুকাল পর আজ আবার তোমার কাছে এলাম,
সমাধিতে তোমার।
আজকাল কিছুই ঠিকঠাক মনে থাকে না আর
তবু তোমার চিরবিচ্ছেদের দিনটা কি করে যেন
ক্যালেন্ডার খুঁজে ঠিকই ধুসর স্মৃতিতে ঢুকে পড়ে।


আমি, আর শ্রদ্ধার্ঘ হাতে অল্প কিছু ভক্ত
তাদের আরোপিত শোক মিছিলের ভিড়ে
অস্পৃশ্য কুন্ঠিত আমি কোনোক্রমে মুখ লুকিয়ে
একটা কুড়িয়ে পাওয়া রক্তজবা ফুল রেখে গেলাম সমাধির ধারে।
হয়তো কারো অর্পনের মালা হতে পড়ে গিয়েছিল।
ভক্তের পদযুগলের নির্মম দলনে যার পাপড়িগুলো থেতলে গেছে
হ্যা, শুধু এটুকুই। এর বেশি কিছু দেবার ক্ষমতা
আজ আর আমার অবশিষ্ট নেই যে।
দেহ, মন, প্রাণ- যা কিছু ছিল উজাড় করে
সবতো তোমায় দিয়ে দিয়েছিলাম, তুমি না চাইতেই।
আমার বলতে ছিল যা, সেতো শুধু তুমিই।


সেই অপরিচীত বুড়ো গাছটার তলে আজ
অনেকক্ষন বসেছিলাম। প্রথম দিনের মতো।
সেই যে, তুমি কালো-সাদার মিশেলে একটা শাড়ি পড়ে
দেখা করতে এলে আমার সাথে। শেষ বিকেলে
শরতের একটা কাঁচা মিঠে রোদ
শাড়ির পাড়ের সাথে জড়িয়ে তোমার সাথে এসেছিল আশ্চর্যভাবে।
অথচ আমি ভেবেছিলাম,
তুমি নীল পড়বে। আর আমি সাদা।
ভালবাসা আর শুভ্রতার রঙিন মেলবন্ধন।
লিপস্টিক দিয়েছিলে কি? আজ এতদিন পরে তা আর মনে পড়ে না।
তবে প্রথম দেখার একটা ফিনফিনে সংকোচ
ঠিকই জড়িয়ে ছিল চোখেমুখে।
ঘরে তোলা কাজলের ঘন গাঢ় টানে
চোখের লজ্জা লুকোনোর একটা ছেলেমানুষি প্রয়াস পেয়েছিলে।
কাজল কৃষ্ন ডাগর চোখের মায়াতে
কালো শাড়ি পড়ার অপরাধ ক্ষমা করেছিলাম মুহূর্তে।
মনে পড়ে তুমি অনেক তাড়া দিচ্ছিলে?
”ঘরে ফিরতে দেরী হলে… মা………”
”নাইবা ফিরলে”…… ”বোস না আরেকটু”
”পাগল”? ”তাহলে আর রক্ষে থাকবে?”
আমি তোমার উদ্বেগ আর লুকোনো ভালো লাগার
যুগপত সৌন্দর্য আকন্ঠ পান করছিলাম।
নাম না জানা গাছটা তার ডালগুলো নুইয়ে
একটু আড়াল দিয়েছিল এই নব যুগলকে।
এমনি করে অনেকগুলো বিকেল, সন্ধ্যে দু’জনে একসাথে
কখনো মরা নদীটার পাড়ে, পোড়ো বাড়ির ধারে সায়াহ্নের
আবছা আলো আঁধারিতে হাতে হাত ধরে
কেটে গেল মন লেনা-দেনার গোপন অভিসারে।
আমি তোমার হতে থাকলেম, একান্তই তোমার। তুমি আমার।
দু’জন দু’জনাকে চিনে নিতে থাকি নতুন করে।


বড্ড ভাল গাইতে তুমি, গান দিয়েই পেয়েছিলাম তোমায়।
ভক্তরা চাইলেই শোনাতে দু’লাইন
শুধু আমায় শোনাতেই লজ্জায় ম্রিয়মান
কোথায় পালাত সব সুর, রাজ্যের যত সংকোচ আর জড়তা
মাঝেমধ্যেই ছেলেমানুষি অভিমান করতাম। ইচ্ছে করেই।
তখন আমায় খুশি করতে তোমার সেকি প্রবল চেষ্টা
সহজে সাড়া দিতাম না, সেও ইচ্ছে করেই।
হঠাৎ গুনগুন করে গেয়ে উঠতে প্রিয় কোনো সুর
পছন্দের দুটো কলি।
“নতুন ধরলে বুঝি?” রাগ ভেঙে শুধাতাম
যদিও তোমার সব গানই আমার মনের অ্যালবামে
সাজিয়ে রাখতাম ভাঁজে ভাঁজে।


একদিন তুমি বড় গায়িকা হলে। আমি
কবিত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে দু’পয়সার কেরানী
তোমার সুর লহরীর মোহমুগ্ধতার বিপরীতে
আমার দু”ছত্র কবিতা, রুক্ষ কর্কশ বেসুরো বকবকানী।
দিকে দিকে তোমার সুনাম কত। হাজারো ভক্ত ধন্য
আজ এই জলসায় তো কাল অন্য
শুধু এই গুনমুগ্ধ চারণ কবির জন্যই
সময় দেবার ফুরসতটা কমে এলো।
ভাটী আসে মরা নদীর পাড়ে বেড়ানোয়
আমি কিন্তু ঠিকই অপেক্ষায় থাকতাম।
বুকে জমত দুর্বাশা অভিমান মেঘ
আর সেই পোড়ো বাড়িটার রোঁয়াকে
ধুলোর মসৃন আস্তরন।


বহুকাল পড়ে আজ আবার মনে পড়ল
সেই বুড়ো গাছতলা, পোড়ো বাড়ির জংলা ভিটে
এতদিনে গাছটা আরো বুড়ো বিবর্ণ হয়েছে। মরা নদীটা আরো জীর্নশীর্ন
আমিও হয়েছি হয়তো আরো একটু বেশী।
তবু তোমার স্মৃতির ডায়েরীটা মলিন হয়নি এতটুকু
পাতায় পাতায় তোমাকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো।
ভাঁজে ভাঁজে তার আজও তোমার হাতের স্পর্শ
ভক্তের হৃদয়ে আজ তুমি অমর আর আমি নিঃস্ব।