হুস করে শেষ ট্রেনটা বেড়িয়ে গেলে
খা খা ন্যাঙটো রেললাইন
সদ্য শিকার গেলা অজগরের মতো এঁকেবেঁকে পড়ে থাকে।
বৈসদৃশ একটা পুরনো খাতার
নির্জিব বাঁধানো মলাটের মতো।
গার্ডের সবুজ পতাকাটা
নেতিয়ে পড়ে বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া বেঞ্চির ধুলোয়
স্টেশান মাষ্টার তেল চিটচিটে টেবিল চেয়ারে
ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ে একটু শান্তির আশায়।  
বহুক্ষণ ধরে সে একটু স্বস্তির অপেক্ষায়।
একজন যাত্রি ট্রেন ফেল করে কিংকর্তব্যবিমুঢ়
হাতের রংচটা ছাতা আর তোরঙ্গটা
সাথে উনত্রিশ বছরের বাজা বউকে নিয়ে
পথ ধরে বাড়ির
পথ হাটে আর আপনমনে বকে।
উনত্রিশ বছরের বাজা বউ
ঘোমটার আড়ালে লজ্জায় আরো ম্রিয়মান
পুরুষের পৌরুষত্ব রক্ষায় ব্যর্থ নারীর
শরমে  ম্রিয়মান হওয়াইতো ললাট লিখন ।


সদ্য কয়লা পোড়ার কটু গন্ধে
বাতাসে একটা চাপা কষ্ট।
একটা বছর তিন চার বয়সের অপুষ্ট শিশু
ট্রেনলাইনের উপরে জলবিয়োগ করে
তপ্ত প্রাণহীন প্লাটফরমটাকে সে যেন তীব্র হলুদ
জলজ ঘৃনায় সিক্ত করে।
”হরিহর হরিহর”-স্টেশান মাস্টার চা হাঁকে
বাদাম ইত্যাদি ফেরিওয়ালা কাঁধের বাঁক নামিয়ে
জিরোয় খানিক।
সস্তা গামছায় মুখের ঘর্মাক্ত ক্লেদ মোছে
পারলে মুছে দেয় ক্লিশ জীবনের
সব অচ্ছুত নোংরা, ব্যর্থ জীবনের দীর্ঘ হতাশা।
একজোড়া শালিক চড়ে বেড়াচ্ছিল
প্লাটফরমের ক্ষয়ে যাওয়া ইটের রাস্তায়।
ঠোঁটে ঠোনা দিয়ে প্রেম বিনিময় করছিল।
শিশুর জলত্যাগ অথবা ঘোমটা টানা বাজা বউয়ের লজ্জা
তাদের রোমান্টিকতায় বিন্দুমাত্র বাধা হয়না।
একটা ব্যাঙ পাশের এঁদো ডোবা হতে ঘাড় উচিয়ে
শালিক দম্পতির প্রেম দেখে ইর্ষান্বিত হয়।
তারও এমন ভরা সংসার……..
সে ছেল কোন এক কালে। সুদিনের কোটরে।
স্টেশানের পুরনো লাল দালানের পাশেই
একটা বুড়ো শিমুল গাছ
বহু বসন্তে ফুল দিতে দিতে আজ নিঃস্ব, রিক্ত
ধুঁকতে ধুঁকতে শ্বাস ওঠা হাপানি রোগীর মতো
তবু একটু ছায়া দেবার চেষ্টা করে স্টেশনটাকে।
গাঁয়ের বৃদ্ধ জয়নাল পাগলা
দু’পা ছড়িয়ে মাইলপোষ্টের পিলারটায় চড়ে বসে থাকে।
কাকতাড়ুয়ার মতো।
লাল হলুদ মেশানো দাঁতে হঠাৎ হঠাৎ ঠা ঠা করে
আপন মনে হাসে।
জাবর কাটার মতো আপন মনে খিস্তি খেউর করে।
ক্ষয়ে যাওয়া গোটা জগতটার উপর
জব্বর রাগে ফুসে থাকে।
সময়ের দেবতা সবটুকু প্রচেষ্টায় এই পান্ডববর্জিত স্টেশানটাকে
যতটা কুচ্ছিত আর কৌরবমন্ডিত করা যায়
কিছু কমতি রাখেননি মোটেই।।
সিগন্যাল বেজে যায়
ওই আরেকটা ট্রেন এলো বুঝি।
ডোবার ব্যঙটার এতক্ষণে সম্বিত ফেরে।
পানাডোবা পুকুরের কিনারে সে ডুব মারে।
মাটিতে একটা মৃদু কম্পন ওঠে।
পাগল জয়নালের ভাবান্তর হয় না।
মাইলপোস্টে পা ঝুলিয়ে
দিব্যি ঠায় বসে থাকে।
নিরন্তর নিস্তরঙ্গ এই বিধবা স্টেশানের নিরবতা
খান খান করে একটা কর্কশ কাক
ততোধিক কর্কশ আর্তনাদে তার সঙ্গিনিকে খোঁজে।
ট্রেন যায় ট্রেন আসে,
বাতাসে কয়লা পোড়ার কটু গন্ধ ভাসে।
যৈবতি প্লাটফরমে
বৈধব্যের হাহাকার থেমে থেমে বাজে।
জয়নাল তবু মাইলপোষ্টে অপেক্ষায় থাকে
”অচীনপুর” লেখা টিনের সাইনবোর্ড
বাতাসে কাত হয়ে তবু ঝুলে থাকে কায়ক্লেশে।
ট্রেন যায়, ট্রেন আসে।
জয়নাল তবু নির্বিকার ঠায় বসে।
ক্ষয়ে যাওয়া এক সভ্যতার নিরব সাক্ষি হয়ে।