(লাম্পেদুসা দ্বিপ থেকে সিসিলির সমুদ্র পথে প্রায় পাঁচশ শরণার্থীর অকাল মৃত্যুকে স্মরণ করে )  

সাঁতরাতে সাঁতরাতে সমুদ্র সৈকতে প্রেমিকার মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল মোগাদিসু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য সাহিত্যে এম এ পাশ করা আব্বেস। ইতালিতে অনেক টাকা আয় করে দেশে ফিরে জিনেবকে সে বিয়ে করবে। ইতিমধ্যে নার্সিং স্কুল শেষ করে জেনেবও তখন নার্স হয়ে কাজ করবে মোগাদিসু হাসপাতালে। দুজনের অর্জিত টাকায় ওরা তৈরি করবে একটি শৌখিন কাঠের বাড়ী।
সমুদ্রের নোনা জল মুছে সোনামুখি একটা শামুক নিয়ে মাথার লম্বা চুল ছিঁড়ে গুঁটি করে প্রিয়তমের কব্জিতে বেঁধে দিয়েছিল জেনেব। মেঘছিঁড়ে চাঁদের আলো চুইয়ে পড়েছিল বালুচরে। বুকে জড়িয়ে ঝমঝম বৃষ্টিতে ওরা ভিজেছিল গোটা রাত। সঞ্চিত যেটুকু ছিল আব্বেসের, তার সাথে জেনেবকে দেয়া তার মায়ের হাতের তিনভরি সোনা দিয়ে বারো’শ  ডলার নিয়ে ভোর না-হতেই ল্যাম্পেদুসায় অপেক্ষমান ছোট্ট জাহাজটিতে আব্বেসকে শেষ চুমু দিয়ে লাল এঁটেল মাটির ঘরে ফিরেছিল জেনেব।
মাত্র শ’দুয়েক যাত্রীকে নিয়ে যে চলতে পারে, সেখানে শিশু-নারী সহ প্রায় পাঁচশ যাত্রী নিয়ে নুব্জ জাহাজটি যখন সিসিলের পথে প্রায় আঠারো ঘণ্টা দিকহারা, পথক্লান্ত ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত যাত্রীরা তখন উদ্ভ্রান্ত, যার যা কিছু ছিল, সেটা দিয়েই তারা দুরের জাহাজ কিংবা সি-পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু, কেউ এলো না তাদের উদ্ধার করতে। তখন মধ্যরাত। শিশুরা তৃষ্ণায় চিৎকার করতে শুরু করেছে, নারীরা আকুল কাঁদতে। আকাশভরা তারা আর চাঁদ ছাড়া কোথাও কোন চিহ্ন নেই। জল আর জল। জলের মত্ত ঢেউয়ে চাঁদের আলো। ওপারের মানুষকে জানাতেই হবে। বুদ্ধি করে কে একজন আগুণ ধরালো কাপড়ে। নিমেষেই দাউ দাউ আগুণ ছড়িয়ে পড়লো  চারিদিকে। একেবারে গায়েগায়ে জড়িয়ে থাকা যাত্রীদের কাপড় থেকে কাপড়ে আগুণ গেলো ছড়িয়ে। উতল জলের মধ্যে ডুব দিলো চাঁদ, আকাশভরা তারা। আব্বেস দেখতে থাকলো ভয়ার্ত মানুষ। মৃত্যুর মুখে অসহায় কান্না, আহাজারি চিৎকার। যে ভাবেই হোক, বাঁচতেই হবে। গায়ে দাউ দাউ আগুণ নিয়ে নিমেষেই ঝুপঝাপ করে যে যেখানে ছিল ঝাপ দিলো জলে। কেউ সাঁতার কাটতে পারছে, কেউ তৎক্ষণাৎ তলিয়ে যাচ্ছে তলে। সমুদ্রের নোনাজলে মৃত্যুর কোলাহল দেখে  Jack London  এর The Sea Wolf -এর ভয়ার্ত ভাবনায় নিথর হয়ে উঠলো ওর শরীর। আগুণের ঝলক তার গায়। হটাত একটা সাইক্লোনে জাহাজটি উল্টে যাবার এমন একটা মুহূর্তে কোনকিছু না-ভেবেই অদৃষ্টের কোলে ঝাঁপ দিলো আব্বাস। পাশের যে ডাগর চোখের তরুণীটি বাবা-মায়ের মাঝখানটিতে জায়গা করে নিয়েছিলো, আঠারো ঘণ্টায় ক্রমশই যার শরীরের চাপে ও ঘামে ঘ্রাণের সাথে পরিচয়, মাথা উঁচিয়ে যে কিছুই না-দেখার উপায় পেয়ে শুধুমাত্র আব্বেসকেই দেখে আসছিলো, হটাত আব্বেসের ঝাঁপের সাথে সাথেই ঝাঁপ দিলো সেও। ‘আমাকে বাঁচাও যুবক’ - চোখেমুখে তার আকুল আবেদন। নিমেষেই সে গলা জড়িয়ে ধরলো আব্বেসের। আব্বেস তাকে বাঁচাতে গিয়ে জড়িয়ে নিল বুকে। কিন্তু সর্বতোভাবেই চেষ্টা করলো তার ডানহাতের কব্জিতে রাখীবন্ধনটি রক্ষে করতে। কোনমতেও নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে না-পেরে অসহায় মৃত্যুমুখী মেয়েটি প্রাণপণে আব্বেসকে জড়িয়ে সম্পূর্ণ সমর্পিত হতে চাইলো। তার বজ্রমুষ্টির বন্ধনে ছিঁড়ে গেলো আব্বেসের রাখীবন্ধন। জলোচ্ছ্বাসের সাথে চীৎকার, কাচভাঙ্গা চাঁদ। পিছনেই আরেকজন মেয়েটির পা ধরে টানছে, তাকে ধরে বাঁচতে চাইছে সেও। আব্বেস সজোরে লাথি মেরে সরিয়ে দিল তাকে। ওর লাথির আঘাতে মানুষটি দূরে সরে যেতেই এক ঝলক চাঁদের আলোয় দেখতে পেলো মেয়েটির বাবাকে। শরীরটা ভারী হয়ে উঠছে আব্বাসের। মেয়েটি শক্ত গরাদের মতো তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে কখনো ডুবছে কখনো ভাসছে। ভেসে যাচ্ছে ডুবে যাচ্ছে আব্বেস। সমুদ্রের নোনা জলে ভরে উঠেছে তার উদর। শিশু সন্তান নিয়ে এতক্ষণ শেষ আশায় যে নারীরা চিৎকার করছিলো ডেকের রেলিং ধরে, তারাও ঝুপঝাপ ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে। মানুষ ডুবছে। জাহাজ ডুবছে। আব্বেস ডুবছে। আব্বেসকে জড়িয়ে মেয়েটি ও তার মা ডুবছে। সেই মুহূর্তে দুদিক দিয়ে তীব্র জোরে হেঁচকা একটা টানে তলিয়ে গেলো সে। ওরা তিনজনই নিমেষে তলিয়ে গেলো সমুদ্রের গভীরে।
সকাল থেকে শুরু হলো উদ্ধার কর্ম। তিনশ’ চুয়াত্তর জনের দেহ খুঁজে পাওয়া গেলো। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে  যথাযথ মর্যাদায় মৃতদের শেষকৃত অনুষ্ঠান হবে, ইটালি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিলো। সিসিলিবাসী মৃতদের কবর তাদের মাটিতে চাইলো। ধর্ম লজ্জিত হলো। পরস্পরের পিঠ চুলকাতে চুলকাতে মানবতা ও গণতন্ত্র সিসিলের সমুদ্র তটে সারিবদ্ধ কফিন ঘিরে শোক প্রকাশ করলো। সবাইকে সুন্দর কাঠের কফিনে রেখে চোখের ঘন ভ্রুতে সিসিলের ধুলো ঝেড়ে সাদা টিসু পেপারটি সযত্নে পকেটে ভরে রাখলো ইউরোপ।  
ইটালি কর্তৃপক্ষ শেষপর্যন্ত কথা রাখিনি। কেউ কফিন পেলো, কেউ পেলো না। সুন্দর একটি কাঠের কফিন পেয়ে আব্বেসের মুখে সাদা গোলাপ ফুটে রইলো । সোমালিয়া দখল করেছিল ইটালি, আজ সেই অধিকারে চিরতরে রয়ে গেল সে ইউরোপে। বাঁচাতে না-পারুক, শেষ পর্যন্ত তার পাশের কফিনে মেয়েটিকে রাখতে পেরেছিল কিনা কে জানে!
মাফেলের হলুদরঙিন পাতা ঝিরঝির ঝরে পড়তে থাকলো সারিবদ্ধ কফিনগুলোর উপর ।