অনেকটা পথ হাঁটতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে / অনিরুদ্ধ আলম


(বর্ণিল বোধের মানুষ Robert Frost, Bob Dylan এবং কবির সুমনকে শ্রদ্ধায়-ভালবাসায়...)


আমার কিছু ছোপানো বন বেনুনি বিল বাহারি ঘাট মাঠ পর্বত আছে
জংলা ডুরে চাতাল চিরে ছুটে-চলা একমুঠো পথ আছে
পথের পাশে পাথার জুড়ে বোতাম পোকার খোশনহবত আছে
সেই-না পথে শিশির-রথে দুলে ওঠে আলো
বর্ণালি জমকালো।
লতাপাতার মুখর কোলাহলে
ঝলকে উঠে আলটপকা উদ্দাম রোদ বলে,
‘ভুলেও যেন পথ চলাতে এই আমরা দেই না কোনো ফাঁকি।
এখনো তো পাড়ি দেবার অনেকটা পথ বাকি।
তোমার মনেও এই কথাটা ঠিক যেন রোজ দীপ্ত অনুরাগে
নিত্যান্দে জাগে
অনেকটা পথ হাঁটতে হবে ঘুমিয়ে পড়ার আগে।’


পিঁপড়েগুলো ডেরা ছেড়ে ছোটে কোথায়? বিরামহীন এদিক-ওদিক ঘোরে
কাজের ঘোরে ছেঁড়াখোঁড়া ন্যাড়া জমি বাঁশের আড়া মাচায় বেড়ায় চ’ড়ে।  
নহলি রোদ ওদের জন্যে ছড়িয়ে হলদে চাদর
বুলিয়ে দেয় আলত ক’রে ভালবাসার আদর।
ওদের এমন ব্যস্ততা সব দেখে
ভাবতে থাকি আমি থেকে-থেকে –
এখনো পথ অনেকখানি বাকি। তা তো পাড়ি দিতে হবে
স্যাঁতসেতে ক্ষেত বেতফুলদের ঝোপ ছাড়িয়ে আঁকাবাঁকা মেঠো পথটা ধ’রে
চলছি ছুটে তাই তো তেপান্তরে।
খুব তো আছি। বেশ তো আছি পথে-পথে রঙমিছিলের আনন্দ-উৎসবে।


কতখানি পথ হেঁটেছি – ভাবার সুযোগ কই?
পথ হাঁটছি। পথ হাঁটছি। পথ ডাকছে অই।


পেছন-ফিরে তাকাব তার ফুসরতটা নেই
খানিক যদি থমকে থাকি, সময়গুলো চমকে দিয়ে পালিয়ে যায় চোখের পলকেই।
সময় বড়ো ছটফটে এক দুরন্ত হরিণ
চলছে ছুটে একটানা তাধিন।
একটুখানি বিশ্রাম সে নিত আহা যদি
এই আমি তো ছুটতাম না ভীষণ নিরবধি।


কিন্তু সময় চলছে ছুটে কী যে উড়োধুরো
আসুক যতই সামনে ডহর সাগর পাহাড়চুড়ো।


পথ চলছি। পথ চলছি। কবে যে পথচলা হবে শেষ?
পথ চলছি। পথ চলছি। পথচলার এ আনন্দটা বেশ।  


পথের কোলে ডোল ঘাসদের ঘেরায়-ফোটা রঙিন মেঠো ফুল
আমার বুকে ভালো লাগার বোধটাকে খুব নাড়িয়ে দেয় হঠাৎ দোদুলদুল।
বড়ুই গাছে স্বর্ণলতার কত্থক দোল দেখে
চড়ুই পাখি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ নাচছে এঁকেবেঁকে
হেঁয়ালিটা ফেলে রেখে খড়কুটোরা উথলে ওঠে হাওয়ায়
ছড়িয়ে পড়ে ঘরের দোরে দাওয়ায়।
আকাশে দল বেঁধে উছল মেঘের ঘোরাঘুরিগুলো বড়ো ভালো লাগে
ভরিয়ে দেয় মনটা আমার ছোটার অনুরাগে
ছুটছি আমি। ছুটছি আমি। ছোটার তো নেই শেষ
সবুজ ঝিলের দেশ পেরিয়ে পাড়ি দেব নীল পাহাড়ের দেশ।


ফুরফুরে ফুটফুটে
ছোট্ট পাখি দোয়েল তুমি চলছ কোথায় ছুটে?
একটা পলক ফিরে শুধু চাও
তোমার আমি বন্ধু হব সঙ্গে যদি নাও।
ঘুমিয়ে গেলে কেমন করে শুনব আমি পাখির কলতান
ঝরাপাতার গান?
এই পথ শেষ হয় যদি আজ থাকবে না আর কাজ  
মিলিয়ে যাবে হৃদয় থেকে বেঁচে থাকার আলো-আশার উজল কারুকাজ।  
দায় হবে খুব খুঁজে পাওয়া এই জীবনের মানে
জাগবে না প্রাণ উতল হয়ে জয়গানের টানে।


ওড়ার নেশায় ব্যাকুল ঈগল কেবল ছোটে নীলাকাশের পাড়ে
বেড়ায় ঘুরে মেঘের দ্বারে-দ্বারে।
দূর-অজানায় হাওয়ার নায়ে পাড়ি দিয়ে ক’রে কিসের খোঁজ
পহরগুলো কাটিয়ে দেয় রোজ?
ওদের কাছে পথ চলতে উৎসাহ পাই খুব
ভাবনাতে দেই ডুব –  
অনেকটা পথ বাকি। তা তো দিতে হবে পাড়ি
পথই আমার ঘর তো জানি। পথই আমার বাড়ি
পথ চলারই মুগ্ধতাকে মনে পুরে ক্লান্তিকে আজ দিয়েছি খুব আড়ি।


পথ চলতে-চলতে দেখি – মউমাছিরা ব্যস্ত ভীষণ কাজে
ওদের ওপর যে-দায়িত্ব ন্যস্ত আছে সকাল দুপর সাঁঝে
করছে পালন দারুণ খেলাচ্ছলে
হাল ছাড়ে না  ফুলে মধুর খোঁজে
অবসাদে ভুলেও তারা মুহূর্তে চোখ কখনই না বোজে  
দূরান্তরে পাড়ি জমায় সবাই দলেবলে।
উড়ে-উড়ে বেড়ায় পথে। অচেনা পথ বন ঝোপ ঝাড় আপন করে ওরা বারেবার।  
নিষ্ঠ পথিক ওদের কাছে পথ চলারই আনন্দটা বড়ো উপহার।  


পথে-পথে কতটা দিন কাটলে তবেই পথিক হওয়া যায়
কতটা পথ হাঁটলে তবেই পথিক হওয়া যায় –
হয়নি জানা কখনো তা। পথ হাঁটছি। পথ হাঁটছি চলার আনন্দে
পথ হাঁটছি ধানটুনিকে গান শুনিয়ে নানান স্মৃতির গল্পগুলো বলার আনন্দে।  


জানি না তো – কতটা পথ পেরুলে ঠিক পথের হবে শেষ
জানা তো নেই। জানা তো নেই। এই তো আছি বেশ।


কতটা পথ মাড়িয়ে গেলে পথিক হওয়া যায়
কতটা পথ ছাড়িয়ে গেলে পথিক হওয়া যায় –
কখনো তা হয় নি ভেবে দেখা
পথ চলছে। পথ চলছি। এই আমাকে প্রতিটা ক্ষণ টানছে পথের দীঘল ফিতে। দিগন্তে নীল রেখা।


মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখি ঘাসের ডগার কাঁপন
মায়াবী এক মিষ্টি মোহে পথকে করি যাপন।  


ফিসফিসিয়ে কানে-কানে অভয় দিয়ে পথ যেন কয়, ‘হারিয়ে যেতে নেই তো কোনো মানা
নতুন কিছু খোঁজার ছলে অজানা পথ মাড়িয়ে যেতে নেই তো কোনো মানা।’


নিঝুম গড়ের নিটল নদী অদম্য তার নাম
বুকজুড়ে যার সারাবেলা মাছ শ্যাওলা নীলাকাশটা ঢেউ-ঢেউ-ঢেউ কলরোলে জাগে
আমাকে সে খুব ইশারায় ডাকে অবিরাম –
চেঁচিয়ে বলে, ‘শোনো তবে, ভুল ক’রো না পাছে
অনেকটা পথ আরও বাকি আছে
পাড়ি দিতে হবে তা তো ঘুমিয়ে পড়ার আগে।‘


কল্পনাতে আল্পনাটা আঁকি –
দিগন্তে প্রায় পৌঁছে গেছি। পথ একটু বাকি
আরেকটু পথ এগুলেই তো স্বপ্ন-মায়ায় ছাওয়া
দিগন্তটা নাগালে যায় পাওয়া।


পথ হাঁটছি। পথ হাঁটছি পথকে গভীর ভালবেসে আমার মতো ক’রে।  
কখনো সেই  কৌতূহলটা জাগে নি অন্তরে –
কতটা পথ হাঁটলে তবেই নীল-নিকানো আলো-ছায়ায় ধোয়া  
ঝিলমিলে অই সুদূরপুরের দিগন্ত যায় ছোঁয়া?