🍁
কত হাজার বছরের এই পৃথিবীর জন্মকথা লেখা আছে কত গবেষণার তত্ত্বে, ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞানে। ভূতত্ত্ব, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান, শিলা ও শিলালিপি, গুহাচিত্র, —কতকিছু প্রামাণ্য দলিল তার।
অথচ, আমার জৌলুসহীন এই জীবনপঞ্জীর গায়ে শুধু ভেসে যাওয়ার ভাষা। প্রতিদিনের বাসি পাঁউরুটি-ঘুগনির জলখাবারের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে নগরীর যাতায়াতের দীর্ঘ রাস্তা। দুপাশে দোকানের পশরা, আকাশচুম্বী বাড়ি আর বিজ্ঞাপনের বাহারি সাইনবোর্ড। কত মানুষ চলেছে রাস্তায় জানা-অজানার ভিড়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। তারই মাঝে ফুটপাত জুড়ে সস্তা ভাতের হোটেল, ধোঁয়া ওঠা চা। ‘বিশ্বাস কেবিন’-এর বিশ্বস্ত চা খেতে কত লোকে ভিড় করে রোজ। শুধু, সবাই চলে যাওয়ার পর রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গাড়ির প্যাঁ-পোঁ আওয়াজ আর ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরা কবেকার পুরনো দু-একটা ট্রামের ঘটাং ঘটাং।
ব্যস্ততার দিনশেষে রাত বাড়ে, কেবিনের ঝাঁপ পড়ে। চারিদিকে শুনশান। রাস্তায় হ্যালোজেনের আলো জ্বলে সারারাত। কেমন অদ্ভুত লাগে, যেন আমাদের জীবনের বিভৎসতার এ এক উদযাপন! খিদে পেটে জলের বদলে জ্বলে দাউদাউ আগুন। ‘বিশ্বাস কেবিন’-এর থালা, বাটি, গ্লাস ধুয়ে আমারই মতো জীবন থেকে, যাপন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিন্নমূল কিছু মানুষ, মধ্যরাতে জেগে থেকে আকাশের তারা দেখে ফুটপাতে চিৎ হয়ে শুয়ে। যাদের স্মৃতি নেই, কেবল বিস্মৃতি আছে। বিরহের মতো আগুনের হল্কা এসে গায়ে লাগে। তবু কেউ ঘুমায় নিঃসাড় নেশার ঘোরে রাস্তার ধারে। পাশে তার বৌ-ছেলে। কী নিশ্চিন্ত অবোধ শান্ত ঘুমন্ত এক সংসার! ফুটপাত জুড়ে এমনই সব নামগোত্রহীন, পরিচয়হীন, শিকড়হীন সংসার ভাসে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আপোষহীন যন্ত্রণার ভিতর হর্ষ, বিষাদ, ত্রাস, শোক, কাম, শৈথিল্য হাতড়ে হাতড়ে ওরা খোলস ছাড়ায়, আবিষ্কার করতে চায় জীবনের সেই অনাস্বাদিত রঙ! এইসব জীবনের পরতে পরতে অলীক ভয়, বিপদ! তবু এরই আসঙ্গে জীবন যুদ্ধের পরিক্রমায়, জীবিকার মধ্যে মুহুর্মুহু ধ্বংসের প্রয়াস থাকে জারি। এই অলীক আসঙ্গে আজীবন কত সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটেছে, আবার কত সম্ভাবনার জন্মের আশায় সেই ছায়ানাট্যের কুশীলব হয়ে শুধু অপেক্ষায় জেগে থাকা।
চলাচল প্রহেলিকা। ভ্রমণ অলীক। পথ জুড়ে পথের অন্তরায়। মারি ও মড়কের পথে খোলস ছাড়িয়ে অন্ধকারে তবু পাথুরে রমণ। ভাগ্যলিপি ছুঁয়ে তবু শরীরী ভ্রমণ,.. আমৃত্যু…


🍁
টালিগঞ্জ, কোলকাতা।
রচনাকাল > ২৫|০৫|২০২৩