জীবনের লক্ষ্য আনন্দ, আনন্দের প্রকাশ হাসিতে, হাসির আছে বহু রকমফের, কেউ আনন্দ পেয়ে হাসে, কেউ অন্যের আনন্দ হরণ করে হাসে, কেউ অপরকে আনন্দ দিয়ে হাসে, কেউ অপরকে যাতনা দিয়ে হাসে, বিধাতা সব জানেন, সব দেখেন, তাঁর হাসি অমলিন l


ব্যক্তি মানুষের জীবন অভিজ্ঞতাকে সমষ্টি মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্মিনন ঘটিয়ে 'অমলিন হাসি' রচনায় কবি জগদীশ চন্দ্র মণ্ডল জীবনে হাসির রসায়ন উদঘাটিত করবার প্রয়াস করেছেন l মানুষ একা বাঁচে না, জীবনের তাগিদেই সে সমাজ গঠন করে, জীবনকে মধুময় করে তোলার জন্য সঙ্গী নির্বাচন করে l জীবনসঙ্গীর থেকে থাকে অনেক প্রত্যাশা, প্রধানতম প্রত্যাশা আনন্দের, এবং আনন্দ থেকে উৎসারিত হাসির l সাগরের ঢেউ হৃদয়ে তুলে তারা আসে l কিন্তু জীবন সর্বদা পরিকল্পনামাফিক চলে না, তার নিজের চলন আছে, সেই চলনের ঘাটে দুলি আমরা, আমাদের সকল চাওয়া পাওয়া, আনন্দ, দুঃখ, বেদনা তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় l যে জীবনসাথীর থেকে অনেক অনেক আনন্দের অভিলাষ ছিল, সেই হয়ে যায় বেদনার উৎস, হাসি মিলিয়ে গিয়ে ব্যক্তিহৃদয় বেদনায় নীল হয়ে যায় l হাসি স্থানান্তরিত হয় বেদনার উৎসে, ব্যক্তির হাসি কেড়ে নিয়ে তার বেদনার কারণেরাই যেন অট্টহাসি হাসতে থাকে l যার কাছে প্রত্যাশা ছিল আনন্দের, সে বিশ্বাসভঙ্গ করেছে, বিষের ছুরি বুকে বিঁধে দুঃখ দিয়েছে l এ কবির একার অভিজ্ঞতা নয়, এমন হৃদয় হারানো মানুষের সংখ্যা অসংখ্য l


এভাবেই মানুষ ভালোবেসে কাঙাল হয়, বেকুব হয়ে যায়, জীবন থেকে হাসি ডানা মেলে উড়ে যায়, নীল আকাশে পাখির মতো তার হাসিগুলো যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় l হৃদয় ভেঙে যায়, আগাছায় ভরা মরুর মত ধূসর জীবনে হাসি বিসর্জিত হয়ে শুধু বেদনারা উথলে ওঠে l তখন গোটা বিশ্বকেই বেদনাময় মনে হয়, ব্যক্তির দুঃখে প্রকৃতিও যেন সমব্যথী, তার বুকের হাহাকার শুনে চাঁদও যেন তার ভাষা ভুলে যায়, জ্যোছনা দিতে ভুল হয়ে যায়, ম্লান হয় তার মুখশ্রী l


এমন নিরাশার দিনে জীবনের থেকে প্রত্যাশাগুলো হারিয়ে যায়, শুধু থাকে শেষের দিনের প্রতীক্ষা l কিন্তু জীবন ঠিক এতটা নিষ্ঠুরও নয়, তার গতিপথে অনেক বিচিত্রতা, অনেক বাঁক l হঠাৎ করে অনেককিছুই ওলটপালট হয়ে যায়, হাসি মিলিয়ে গিয়ে যেমন দুঃখ আসে, তেমনই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো একরাশ আনন্দ এসে পড়ে জীবনে, হতাশা দূরীভূত হয়ে জীবনের শেষ বিকেলে যেন দিবাকর একরাশ হাসি ফিরিয়ে দেয় l যেন সকল ছলনা বিসর্জন দিয়ে জীবনসঙ্গী সামনে এসে দাঁড়ায়, অনুতাপবিদ্ধ শুদ্ধ মন নিয়ে, জীবন আবার আনন্দময় হয়ে ওঠে, আবার জীবন হাসিতে খেলে যায় l


মানুষ বর্তমানকে দেখে শুধু, ভবিষ্যত তার অজ্ঞাত l দুঃখের সময় দুঃখটাকে সে বড় করে দেখে, সুখের সময় সুখকে l মেঘের আড়ালে কি আছে সে জানে না, তার বর্তমান দুঃখের জীবন কেটে গিয়ে অচিরেই যে আনন্দের সোনালী ভুবন তার জন্য হাসির ফোয়ারা নিয়ে অপেক্ষারত, সেটা না জানার কারণে সে বর্তমানের দুঃখে কাতর হয়ে মৃত্যুকে কামনা করে l কিন্তু ইশ্বর সব জানেন, ভূত ভবিষ্যত তাঁর জানা, তাই মানুষ যখন তাঁর বর্তমান বেদনায় কাতর হয়ে হাসি ভুলে যায়, বিধাতার হাসি তখনও অমলিন থাকে l
দুঃখ আনন্দ জীবনের অঙ্গ, পালা করে আসে, মানুষ এই সত্য বিস্মৃত হয় বলেই মাঝে মাঝে দুঃখের প্রাবল্যে জীবন তার কাছে দুর্বিষহ মনে হয় l বিধাতা সর্বজ্ঞ, তিনি এটা জানেন বলেই তাঁর মুখ থেকে হাসি কখনো হারায় না l ইশ্বরে বিশ্বাসী মানুষ হৃদয়ে সর্বদা এমন সুখের সাগর অনুভব করেন, জীবনের জাগতিক দুঃখ তাঁদের কাতর করতে পারে না l


কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা !!