মা,
তোমার শরীর অনেকদিন থেকেই খারাপ,  
বছর তিনেক থেকেই একটু একটু করে
খারাপের মাত্রা বেড়ে চলেছে, আমরা তা
বুঝেছি এবং অসহায়ভাবে দেখে চলেছি।
আড়াই বছর আগেও তুমি সৈয়দপুর থেকে
ডমেস্টিক ফ্লাইটের প্লেনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে,    
ঢাকা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলে। অথচ আজ
তুমি চলৎশক্তিহীন, একা বসতেও পার না।  
তোমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হচ্ছে।
বোধশক্তি বিলুপ্ত হচ্ছে অনিমিখ দু’আঁখির
অতলান্ত ভাবসায়রে, যেখানে আমাদের
নেই কোন প্রবেশাধিকার! নিত্যদিন তুমি
সেখান থেকে অনুক্ষণ কুড়িয়ে আনো,        
কত কি মণিরত্ন তা কেবল তুমিই জানো!


তোমার বাকশক্তি এখনো সক্রিয়, কিন্তু সে
বাক দুর্বোধ্য। তোমার স্মৃতির বিশাল সম্ভার
ক্রমশঃ হ্রস্ব হতে হতে কেবলই খাবি খাচ্ছে
তোমার শৈশবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবে
যা মন্বন্তর আর বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল!
তুমি এখন তোমার সে শৈশবের বান্ধবীদের  
নাম ধরে ডাকো, অথচ তুমি তোমার নিজের
নামটি ভুলে গেছ, তোমার ছেলেমেয়েদেরও!


তোমার কথা জেনে আমার এক অশীতিপর  
শিক্ষক, যিনি নিজে আজ বয়সের ভারে ন্যুব্জ
এবং যষ্টিনির্ভর, আমাকে ফোন করে বললেন,
‘তুমি তোমার মায়ের পদস্পর্শ করে দয়া মাগো
স্রষ্টার, সন্তানের দোয়া তিনি কখনো ফিরান না,
কোন প্রতিকার কিংবা শ্রেষ্ঠতর বিনিময় ছাড়া’।  
তাঁর কথাটা আমার মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে র’লো!
নিজস্ব পন্থায় তো অনেক দোয়াই করি প্রতিদিন,
এবারে তাঁর পন্থাটি অনুসরণ করার জন্য আজ
আমি রওনা হ’লাম তোমার পদপৃষ্ঠের সন্ধানে!      


মা, তোমার ঘরের ঠিকানাটা আমি যদিও জানি,  
তোমার মনের ঠিকানাটা, হালের বোধ-ঠিকানাটা    
আমার জানা নেই। এ চিঠিটি তাই লিখে চলেছি
ঠিকানাবিহীন, জানি এটা তুমি কখনোই পাবে না।
যানজটের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে আমি তোমায়
এ চিঠিটি লিখে চলেছি, সারাটা পথ তোমায় ভেবে।
শ্যাওড়া থেকে উত্তরা, ক্ষুদ্র এ পথটুকু পাড়ি দিতেই
পাঁচ পাঁচটি ঘন্টা পার হয়ে গেল স্থবির জটে বসে।
অথচ যেতে হবে আরো কত পথ, তিনশত কি.মি!
পথের যে অবস্থা, অন্যদিন হলে ফিরে চলে যেতাম।
কিন্তু আজ আমার মন বলছে, কষ্ট হলেও, এ পথ
এক সময় শেষ হয়ে আসবে, আমি ঠিকই পৌঁছাব  
তোমার কাছে। হয়তো বিকেলে নয়, গভীর নিশীথে।  
তোমার আশিসের কাছে সব দুর্ভোগই যে কত তুচ্ছ!    


(ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে অসহ্য যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় রচিত। সাত/আট ঘন্টার যে পথ সতের ঘন্টায় শেষ হয়েছিল!)


ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বিভিন্ন অংশ থেকে....
১৫ জুন ২০২১