প্রেম-বিরহ:—


কান পেতে শোন, সুরের বাঁশিটা কোন কথা যেন কয়
বিরহের সব অভিযোগ নিয়ে করে খুব অনুনয় !
বাঁশবন হতে আমাকে যখন ছিন্ন করিয়া নিলো
আমার কান্না ও আর্তনাদে সকলেই কেঁদেছিলো ।
তোমরা আমার এ অবস্থাকে অস্বীকার করো বুঝি
যাঁহার বক্ষ শোকে বিদীর্ণ এমন কাউকে খুঁজি ।
যেজন প্রিয়র নিকট হইতে গিয়েছে খানিক সরে
পুনরায় সে-তো মিলন যুগের মধু সন্ধান করে ।
আনন্দময় ওইদিন হবে আমার সোনালী ভোরে
এ কয়েদখানা ছেড়ে যাবো আমি প্রেমাস্পদের ক্রোড়ে।


জনসমাবেশে জনসম্মুখে কত-না দুখের জলে
ভালো ও মন্দ সবার সাথেই মিলেছি নানান ছলে ।
সবাই সবার খেয়াল মতন আমার বন্ধু সাজে
কিন্তু কেউ-তো টেরই পেলো না, গুপ্ত কী মোর মাঝে !
আমার সাথেই মিশে আছে মোর সব বেদনার গতি
দেখবার মত নেই কোন চোখ নেই কারো সেই জ্যোতি ।
দেহ হতে প্রাণ অভিন্ন হায়, দুটোই যে একাকার
দেহ দেখা যায়, প্রাণটা দেখবে সাধ্য আছে তা কার?
বাঁশির এ সুর আগুনের ঝড় মৃদু সমীরণ নয়
এ আগুন ভিন আত্মা তাদের নিত্য মরণ হয় ।


যে আগুন বুকে জ্বলছে ভীষণ দাউদাউ দিবানিশি,
এ আগুন হতে তৈরি হচ্ছে শরাব একেক শিশি ।
বন্ধুর থেকে দূরে আছে যাঁরা বন্ধু তাদের বাঁশি
এ বাঁশির সুর দিলের পর্দা ছেদ করে বারোমাসি ।
কোন বিষ নাই নফসের তরে আর এ বাঁশির সম
রুহের জন্য মহা ঔষধ, বান্ধব প্রিয়তম ।
খুন রাঙা পথ বর্ণিত হয় এ বাঁশির সুর ধরে
আশেকদেরই কাহিনী শুনিয়ে ভীষণ পাগল করে ।
বেহুশ না হয়ে আসল তত্ত্ব পায়নি কেউ তো ভবে
রসনার কথা খরিদদাররে দিয়ে কী তা শোনা হবে?


প্রেমিক মনের চিন্তা জীবন পুরোই বিফল হলো
জীবনে শুধুই জ্বালা-যন্ত্রণা সাথী হয়ে মোর রলো ।
জীবন বিফলে গিয়েছে যাক্ গে কোনোই পরোয়া নাই
নির্মল প্রেম থাকলে আমার জীবনে সর্বদাই ।
এশকের গুণ অল্প যাদের, থেমে যায় ফোটা পেয়ে
মহান আশেক সাগর পেয়েও পিপাসায় রয় চেয়ে ।
অপরিপক্ব মানুষ যেজন বুঝতে সে অক্ষম
তাদের নিকট এই রহস্য ব্যক্ত করবে কম ।
সব শৃংখল থেকে তুমি আজ মুক্ত হও গো তবে
আর কতকাল দুনিয়ার মোহে নিজেকে জড়িয়ে রবে?


সাগরকে যদি এক পেয়ালায় ঢেলে দাও একবারে
কতটুকু আঁটে ক্ষুদ্র পাত্রে খুব বেশি থাকে না রে ।
লোভী ব্যাক্তির চক্ষু-পেয়ালা সহজে কখনো ভরে?
অল্পে তুষ্ট ঝিনুক সহজে মুক্তা কামাই করে ।
প্রেমের আঘাতে যাহার বস্ত্র ছিন্ন হইয়া গেল
সে মানুষ লোভ, দোষ-ত্রুটি হতে কেবল মুক্তি পেলো।
মঙ্গল হোক হে প্রেম তোমার, তুমি বিশুদ্ধ ধ্যান
তুমি আমাদের সকল রোগের মহা চিকিৎসা জ্ঞান ।
তুমি আমাদের রূহানী ব্যাধির সেরা রোগনিরাময়
আত্মিক রোগে মুক্তি মিলছে তোমারই ওসিলায় ।


প্রেম সিঁড়ি দিয়ে মাটির দেহ যে আসমানে পৌঁছায়
বিশাল পাহাড় আনন্দে তাই নাচিয়া উঠিলো হায় ।
এ-প্রেম যখন তূর পর্বতে প্রাণের স্বরূপে এলো
উন্মাদ তূর আর মূসা নবী হুঁশহারা হয়ে গেল ।
আহা আমি যদি কোন বন্ধুর ঠোঁটে ঠোঁট রাখিতাম
বাঁশির মতন অব্যক্ত কথা তার সাথে বলিতাম ।
যেজন নিজের কথার সাথীর থেকে বিচ্ছেদ হয়
জ্ঞান থাকলেও প্রকাশ করার পাত্র কী আর রয়?
ফুল মৌসুম পার হয়ে গেলে খালি হয় উদ্যান
তখন তো আর শুনবে না রে বুলবুলিদের গান ।


মৌসুম শেষ হওয়ার সাথেই বাগান উজাড় হলো
ফুলের খুশবু খুঁজবে কোথায় বুলবুলি আজ, বলো ।
লুকায়িত আছে গোপন তথ্য বাঁশির সুরের ভাবে
প্রকাশ করলে পৃথিবীর সব উল্টেপাল্টে যাবে ।
মাতাল করা এ-সুরের বাঁশিটা যাহা কিছু যায় বলে
প্রকাশিলে আমি বিশ্বজগত যাবে সব রসাতলে ।
জগতের সব প্রিয় মা'শুকের প্রেমময় আয়োজন
আর সমস্ত আশেক হচ্ছে তার মহা আবরণ ।
মাশুক জীবিত সদা জাগ্রত দয়ালু মেহেরবান
সকল আশেক তাকে ছাড়া সদা মুমূর্ষু, নিষ্প্রাণ ।


মেঘমালা হতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সাগরের বুকে
তুচ্ছ তেমনি আমার সত্তা তোমার-ই সম্মুখে ।
তুমি মোর প্রতি কৃপা না করিলে বাঁচিবো কেমন করে
পালকহীন সে পাখির মতন রইবো ধুলায় পড়ে ।
আমার প্রিয়র প্রেমালো যদি গো না হয় চলার সাথী
কোনো খবরই রবে না আমার জীবন আঁধার রাতি ।
তার নূর মোরে চারিদিকে ঘিরে রাখে উজ্জ্বল করে
বেড়ির মতন বেষ্টনী দেয়া ঘাড় ও মাথার পরে ।
অসীম প্রেমের আলোকছটা যে ছড়িয়ে পড়তে চায়
হৃদ দর্পণ অসচ্ছ হলে সে আলো কী পৌঁছায়?


তুমি কী জানো যে, হৃদ দর্পণ অসচ্ছ কেন ভাই
উহার উপর মরিচা পড়ছে দূর করা হয় নাই ।
দর্পণ হলে মরিচাবিহীন খুবই পরিষ্কার
রবির আলোয় প্রতিবিম্বিত হয় রে চমৎকার ।
তবে দেরি কেন, হৃদয়ে মরিচা তাড়াতাড়ি করো দূর
পাক-সাফ হৃদে অনুভব করো মহান প্রিয়র নূর ।


(মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহ.-এর অমর গ্রন্থ মসনবী শরীফ থেকে অনুদিত)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ ৬+৬+৬+২