মেহমানের সাথে বাদশার সাক্ষাৎ:—


এখন আবার বাদশার সেই কাহিনী শোনাতে চাই
আদবের কথা এখানে ক্ষান্ত, আদবের শেষ নাই ।
তখন যদিও বাদশাই ছিল তবুও সে একেবারে
অতিথির কাছে গেল বিনয় ও নম্রতা সহকারে ।
হাত প্রসারিত করিয়া তাহাকে জড়ালো আলিঙ্গনে
প্রেমের মতোই মেহমানকেও ঠাঁই দিলো তাঁর মনে ।
চুমু খেয়ে খুব বাদশা তাহার হস্ত, ললাট পরে
বাড়ির খবর পথের খবর সব জিজ্ঞাসা করে ।
জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে নিয়ে যায় মনজিলে
অনেক ধৈর্য সবরের পরে বুঝি এই ধন মিলে ।


ছবর করাটা খুবই কঠিন, মোটেও না দূর্বল
তবে ছবরের পরিনামে হয় স্বাদে সুমিষ্ট ফল ।
আপনাকে দিয়ে এ-বিপদে প্রভু উদ্ধার করে নিলো
ছবর আর যে সচ্ছলতার চাবিকাঠি হাতে দিলো ।
আপনাকে দেখে হয়ে গেছে আজ সব প্রশ্নের হল্
সমস্যা যত, বলা শোনা ছাড়া সমাধান উজ্জ্বল ।
ব্যক্ত করেন যত সমস্যা আছে এই অন্তরে
যার পা কাদায় আঁটকে গিয়েছে তুলিয়া আনেন ওরে
স্বাগত জানাই ওহে পবিত্র, বড় দামী মেহমান
আপনারকে ছাড়া শঙ্কিত হায় আমার জীবন প্রাণ ।


আপনি সবার হিতাকাঙ্ক্ষীও মানুষের সহায়ক
আপনার প্রতি নিরুৎসাহী যে তাহার ধ্বংস হোক ।


রোগিণীর শিয়রে মেহমান চিকিৎসক:—


এই মজলিসে কথোপকথন, শেষ করে সাক্ষাত
বাদশা তাহাকে ভিতর মহলে নিয়ে যায় ধরে হাত ।
বাদশা তখন চিকিৎসককে বলে রোগীণীর হাল
রোগিণীর পাশে বসাইয়া দিলো করতে যে দেখভাল ।
চেহারার রং, স্নায়ু গতিবিধি সব দেখে কিছুক্ষণ
শুনলেন তার রোগের সকল কারণ ও লক্ষ্মণ ।
পূর্বের সব চিকিৎসকরা রোগটাই বোঝে নাই
ভুল চিকিৎসা রোগিণীর রোগ বেড়েছে এমনটাই ।
তারা রোগীনীর অভ্যন্তর বিষয়ে বিজ্ঞ নয়
উহার জন্য আল্লা'র কাছে চাই আমি আশ্রয়।


রোগের বিষয় প্রকাশিত হলে রহস্য বুঝে নেন
বাদশার কাছে না বলে সেসব গোপন রাখিয়া দেন ।
রোগিণীর রোগ পিত্ত, অম্ল থেকে নয় উদ্ভব
প্রতি জ্বালানির ঘ্রাণ হয় তার ধোঁয়াতেই অনুভব ।
কাঁন্না দেখিয়া অনুমান করে কিসের রোগে সে ভোগে
শরীর নীরোগ মরছে রোগিণী নিজ আত্মার রোগে ।
তার হাহুতাশ আশেক হওয়ার দিচ্ছে রে পরিচয়
এশকের ন্যায় কোন রোগ আর নাই রে বিশ্বময় ।
আশেকের রোগে ভিন্নতা রয় আর সব রোগ ছাড়া
মাওলা-তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যায় এশকে এলাহী দ্বারা।


এই প্রেম যদি কোন প্রেমিকের হৃদয়ে জায়গা পায়
প্রেম প্রেমিককে উড়িয়ে তখন আল্লা‘তে পৌঁছায় ।
প্রেমের ব্যাখ্যা প্রেম বর্ণনা যতোই করি না কেন
নিজেই যখন প্রেম অনুভবি লজ্জিত হই যেন ।
সব রসনার ব্যাখ্যা যদিও বস্তু দিয়েই হবে
বর্ণনাতীত শুধু এই প্রেম বুঝবে তা অনুভবে ।
যখন কলম ভিন্ন লেখায় দ্রুত চলছিল হায়
প্রেমের বিষয় লিখতে গিয়ে এ কলম থামিয়া যায় ।
হৃদয় যখন বর্ণনা দিবে প্রেম কাহিনীর ঘাঁটি
কলম তখন ভাঙলো রে আর কাগজও যায় ফাটি ।


প্রেমের ব্যাখ্যা করতে এবার লাগাই বিবেকটারে
সে-ও যে ব্যর্থ, প্রেমের ব্যাখ্যা প্রেমেই করতে পারে ।
সূর্য নিজেই তাহার প্রমাণ আকাশে উদিত হলে
যদি সূর্যের প্রমাণ চেয়েছ, বের হয়ে যাও চলে ।
ছায়া যদি ওর প্রমাণ হয় গো আলোকিত দিবাকরে
হক্কের সূর্য নূর দান করে আরেফের অন্তরে ।
সূর্যের ছায়া ডুবে গেলে সব তখন অন্ধকার
সূর্য উঠিলে চন্দ্রের বুকে আলো যে থাকে না আর ।
কোন মুসাফির দুনিয়াতে নাই ওই সূর্যের ন্যায়
কিন্তু আল্লাহ্ অস্ত যান না আরেফিন আত্মায় ।


যদিও সূর্য একটাই আছে আকাশের আঙিনায়
তবে ওর ন্যায় বহু সূর্যকে কল্পনা করা যায় ।
ওই সূর্যের তাপমণ্ডল যে হাতে নিয়ন্ত্রিত
তাহার নজীর হয় না কখনো খেয়ালেও অঙ্কিত ।
যেই সত্তাকে ধরতে পারি না আমরা কল্পনাতে
কেমনে আবার নজীর আসবে সেই সত্তার জাতে ।
আবার শামসে তাবরেজী যিনি মহান কামেল নূর
তিনিও একটি সূর্য প্রভুর নূরে নূরে ভরপুর ।
তাবরেজী তক্ যখনই এই আলোচনা পৌঁছিল
আকাশে সূর্য লজ্জায় পড়ি মুখ লুকাইয়া নিল । (৩০০)


এসেই পড়লো যখন তাহার নামেরই আলোচনা
সেহেতু উচিত তাঁর ‘এহসান’ কিঞ্চিৎ বর্ণনা ।
আমার প্রাণটা মজবুত করে ধরে আঁচলের কোণে
সে ইউসুফের জামার গন্ধ পেয়েছে রে এতক্ষণে।
এ-রূহ আমাকে বলছে, ছিলে যে সহবতে বহুকাল
সেই হতে কিছু বর্ণনা করো তার মোবারক হাল ।
তাহলে জমিন আর আসমান হবে আরো আলোকিত
বিবেক, আত্মা, জ্ঞান-চোখ হবে ভীষণ প্রজ্জ্বলিত ।
হে রূহ! যে রোগী চিকিৎসকের থেকে রয় বহুদূরে
তেমন তুমিও প্রিয় মোর্শেদ ছেড়ে আছ জ্বলেপুড়ে ।


নিজ সত্তাকে মিটিয়ে দিয়েছি করিও না অনুগত
নিস্তেজ জ্ঞানে— তার বর্ণনা? সক্ষম নই তত ।
অচেতন লোক যা কিছু বলবে যত মনে জোর দিক
যাহাই বলুক তার কোন কথা, হবে না কিছুই ঠিক ।
যাহা কিছু বলে সময়োপযোগী হয় না-তো কোনদিন
বানানো কথার মতোই লাগবে সব গুরুত্বহীন ।
মোর্শেদ-হাল এহসান হলো সুগভীর অনুভব
বেহুঁশ থাকিয়া সেই আলোচনা কেমনে গো সম্ভব?
বিরহ দহন, কলিজা খুনের, চলমান বর্ণনা
পরিত্যাগ করো, অন্য সময় করা যাবে আলোচনা ।


রূহ বলে আমি ক্ষুধার্ত খুব তাড়াতাড়ি করো তাই
সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই এশকের স্বাদ চাই ।
হে সূফী! তোমার এখনি এশক বর্ণনা দরকার
কালকে বলবো, এই কথা বলা পন্থা না তরিকার ।
সুফি লোকদের ‘এবনুল হাল’ বলে যে উদাহরণে
কোন সংযোগ নেই উভয়ের মাস বছরের সনে ।
রূহ বলিতেছে, মনে হয় তুমি সূফী মানুষ কি নয়
তুমি কী জানো না বাকি অর্থতে নগদের ক্ষতি হয় ।
রূহ কে বলি যে গোপন তথ্য গোপনে রাখাই প্রিয়
শুনিবেই যদি তবে একান্তে ইঙ্গিতে শুনে নিও ।


রূহ বলে ওগো, আমাকে কষ্ট দিও না এভাবে আর
কোন কিছু তুমি গোপন না করে বলো গো পরিষ্কার ।
বর্ণনা করো নবীদের ভেদ ইশারা-ইঙ্গিত গুলি
দ্বীনের বিষয় গোপন না রেখে বলো সব খোলাখুলি ।
গোপন রাখার পর্দা সরিয়ে হাকিকত বলো তবে
প্রিয়ার সহিত শয়ন করতে আড়াল কেন বা রবে ।
আমি বললাম, যদি এই ভেদ প্রকাশ হইতে পারে
ধ্বংস হইবে বিশ্বজগত তুমিও থাকবে না রে!
তোমার কাম্য বস্তু চাই-ও নিজ পরিমাণমত
পাতা হয়ে এক পাহাড়ের ভার সহ্য করিবে কত?


এখন তোমার সেলাই করিয়া, আটকাও চোখ, মুখ
বিশ্বজগত না হয় যেন গো ধ্বংসের সম্মুখ ।
এই যে দেখো সূর্যের আলোয় বিশ্বভূবন চলে
একটু আগালে ভস্ম হইবে সবকিছু তাপে জ্বলে ।
পড়িও না আর ফেতনা-ফাসাদ রক্তপাতের পিছু
এশকের ভেদ জানার জন্য বলিও না আর কিছু ।
এই আলোচনা সুদীর্ঘ খুব শেষ নেই তার কোন
চলো রে, এখন কাহিনীটারও বাকী সে অংশ শোনো!


(মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহ.-এর অমর গ্রন্থ মসনবী শরীফ থেকে অনুদিত)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ ৬+৬+৬+২