বাদীর রোগ নির্ণয়ে চিকিৎসকের নির্জনতা কামনা:—


চিকিৎসক তো বের করলেন বাদীর কী রোগ, খুঁজে
বাদশার সব গোপন তথ্য তা-ও যে গেলেন বুঝে ।
তখন বলেন, খালি করে দিন আমায় পুরোটা ঘর
ঘর থেকে সব বের করে দিন থাক না আপন পর ।
কেউ যেন কান পাতিয়া না থাকে এই দরজার কাছে
গোপনে বাদীর নিকটেই কিছু প্রশ্ন করার আছে ।
ঘর খালি করে বাদশা নিজেও বের হয় নির্দ্ধিধা
বাদীর নিকটে জিজ্ঞাসাবাদে থাকে না রে অসুবিধা ।
স্নেহ ভরে তারে জিজ্ঞাসা করে কোথায় তোমার বাড়ি?
প্রত্যেক দেশে চিকিৎসাতেও ভিন্নতা আছে ভারি ।


ওই দেশে কেউ আছে কি তোমার ভীষণ আপনজন
কারো সাথে কোন আত্মীয়তায় টানছে তোমার মন?
শিরার উপর হাতটা রাখিয়া ফের জিজ্ঞাস করে
আসমানী বালা-মুসিবত ও রোগের নাম ধরে ।
যখন কারোর নিজ পায়ে কাটা বিদ্ধ হইয়া থাকে
কাটা খুলিবার জন্য নিজ পা হাঁটুর উপরে রাখে ।
সুঁইয়ের মাথা দিয়ে তারপর কাঁটার মাথাটা খুঁজি
খুঁজে না পাইলে ঠোঁট দিয়ে উহা ভিজিয়ে নেয় গো, বুঝি।
পায়ের এ-কাটা খুঁজে পাওয়া কত কষ্টসাধ্য তবে
হৃদয়ের কাটা খুঁজে বের করা ভেবেছ কেমন হবে!


হৃদয়ের কাটা যদি সকলেই দেখতে পাইতো চোখে
দুরবস্থায় আচ্ছন্ন তবে থাকতো না কোন লোকে ।
গাধার লেজের নিচে যদি কাটা বাঁধে কোন আলাভোলা
গাধাটা শুধুই লাফাতে থাকবে জানে নাতো কাটা খোলা।
গাধা লাফালাফি করে আরো কাটা বাঁধায় শক্ত করে
বিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন হয় কাটা খুলিবার তরে ।
কাঁটার কষ্ট দূর করতে এ গাধাটা লাফায় কত
জখম করিয়া ফেলে শরীরের জায়গায় শত-শত ।
লাথি মারলে কি কাটা দূর হবে, বিপদ কাটিয়া যাবে
জ্ঞানী লোক চাই, অনুসন্ধানে কাটা খোলে ভালোভাবে ।


চিকিৎসক সে এ বিষয়ে ভালো ছিলেন বিচক্ষণ
শরীরের পরে হস্ত রাখিয়া করেন নিরীক্ষণ ।
বাদীর নিকটে সরলতা নিয়ে স্বাভাবিক অন্তরে
গত জীবনের অবস্থাবলী সব জিজ্ঞাসা করে ।
বাদী তাঁর কাছে নিজের দেশের সবকিছু বলে দিল
কোথায় সে ছিল কার কাছে ছিল কে কে ওরে কিনেছিল।
চিকিৎসক সে কান খাড়া রাখে বাদীর কথায় অতি
গভীর খেয়াল রাখে ওর শিরা-স্পন্দন প্রতি ।
যাহার নামের সাথে সাথে ওর শিরা চঞ্চল হবে
সেজনই ওর এই দুনিয়ায় প্রাণ-প্রিয়তম তবে ।


বাদী প্রথমেই নিজ শহরের পরিচিত ছিল কারা
তারপর বলে, ভীন শহরের পরিচিত ছিল যারা ।
বলো, তুমি নিজ শহর হইতে যবে বের হইয়াছ
কোন শহরেতে বেশিদিন তুমি বসবাস করিয়াছ?
এক শহরের নাম বলে তার, করে সব বর্ণন
কিন্তু বাদীর চেহারা, শিরায় তেমনই লক্ষ্মণ ।
নিজের বসতি, শহরের কথা একে একে সব খুটি
বলছে ওদের খাদ্যবস্তু ছিল যে নিমক, রুটি ।
প্রতিটি শহর, সকল বাড়ির সব করে বর্ণিত
তবুও বাদীর শরীর-অঙ্গ হচ্ছে না আলোড়িত।


এতক্ষণ বাদী পূর্বের মতো খুব স্বাভাবিক ছিল
সবশেষে ওরে ‘সমরকান্দ’ বিষয়ে জিজ্ঞাসিল । (৪শ)
বাদীর শিরার গতি বেড়ে গেল চেহারা হইলো লাল
সেই শহরের স্বর্ণকারের থেকে দূরে বহুকাল ।
আলোচনা যবে ‘সমরকান্দ’ শহরেতে পৌঁছায়
চাঁদমুখী বাদী নিঃস্বাস ছাড়ে চোখ ভেজে কান্নায় ।
বাদী বলে এক ব্যবসায়ী মোরে সেখানে আনিয়াছিল
সেই শহরের স্বর্ণকার সে আমায় কিনিয়াছিল।
তিন মাস রেখে আমাকে আবার বিক্রি করিয়া দিল
একথা বলেই, মনঃকষ্টের আগুনে জ্বলতেছিল ।


রোগিণী হইতে এ-সব তথ্য জানা গেল তবে সব
রোগের আসল কারণটাও হলো বেশ অনুভব ।
বলো, ‘কোন পথে, কোন মহল্লায় থাকে সে স্বর্ণকার’
‘পথের নাম যে সারেপোল আর গলি তার গাতফার ।’
চিকিৎসক সে বাদীকে বলেন, চিন্তা করো না অতি
এবার তোমার রোগ-যাতনায় পেয়েছ অব্যাহতি ।
যখন হয়েছে তোমার রোগের বিষয়টা নির্ণয়
খুব ক্রিয়াশীল তদবির আমি করবো তো নিশ্চয় ।
প্রফুল্ল রাখো মুক্ত মনন চিন্তা করো না আর
দেখবে তুমি যে বৃষ্টির সাথে বাগিচার ব্যাবহার ।


তোমার চিন্তা আমিই করছি চিন্তিত তাই দিল্
তোমার জন্য পিতার চেয়েও আমি বেশি স্নেহশীল ।
সাবধান! এই গোপনীয় ভেদ বলবে না তুমি কভু
বাদশা যদিও তোমাকে ভীষণ পীড়াপীড়ি করে তবু ।
এ গোপন কথা কারো কাছে তুমি বলো না খবরদার
কারো সম্মুখে খুলিও না তুমি, কখনোই এই দ্বার।
গোপন তথ্য তোমার মনেতে থাকে যদি রক্ষিত
তাড়াতাড়ি হবে সফল তোমার ইচ্ছে যা কাঙ্ক্ষিত ।
যে ব্যক্তি তার গোপন বিষয় লুকিয়ে রাখবে যত
তাহার লক্ষ্যে সফলতাটা-ও তাড়াতাড়ি পাবে তত ।


দেখ এই বীজ, জমিনের বুকে গোপন হইয়া গেলে
তারপরেই তো শস্য-শ্যামল সবুজ বাগিচা মেলে ।
সোনারূপা যদি মাটির নিচে না থাকতো গোপনে চুপে
দামী ধাতু হতো উপরে থাকলে স্বর্ণ-চান্দিরূপে?
চিকিৎসকের ওয়াদা এবং বাণী ছিল মধুময়
আশংকা হতে বাদীকে তখন করে দিল নির্ভয় ।
সত্যিকারের প্রতিশ্রুতিকে হৃদয় গ্রহণ করে
মিথ্যা যেসব প্রতিশ্রুতি তা ব্যথা দেয় অন্তরে ।
উচ্চ লোকের ওয়াদা তা যেন বড় ধনভাণ্ডার
নিম্ন লোকের ওয়াদা হয় রে অন্তরে বেদনার ।


ওয়াদা পূরণ আবশ্যকীয় যদি না করেছ তবে
তবে তুমি কাঁচা, অলস বলিয়া ঠিক প্রমাণিত হবে ।
মনপ্রাণ দিয়ে ওয়াদা পালন সর্বদা করে যাবে
বিচারের দিনে ওয়াদা রাখার সুফল দেখতে পাবে ।



(মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহ.-এর অমর গ্রন্থ মসনবী শরীফ থেকে অনুদিত)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ ৬+৬+৬+২