রোগ নির্ণয়ান্তে বাদশার নিকট প্রকাশন:—


চিকিৎসক তো গোপন বিষয়ে হইলেন অবগত
বাদীর রোগের কারণসমূহ বুঝলেন ভালোমতো ।
সেখান হইতে উঠে তিনি যান বাদশার কাছে চলে
বাদীর রোগের বিষয়ে তখন হালকা কিছুটা বলে ।
বাদশা বলেন, এখন বলুন কী করবো তদবির
এ-চিকিৎসায় কোনভাবে দেওয়া যাবে না মোটেও ধীর ।
চিকিৎসক সে, বলেন রোগিণী সুস্থ হইবে তবে
এর লাগি সেই স্বর্ণকারকে হাজির করতে হবে ।
স্বর্ণকারকে সেই দেশ থেকে আনেন গো ডাকাইয়া
সোনা রূপা আর পোশাকাশাকের প্রলোভন দেখাইয়া ।


একজন দূত পাঠিয়ে দেন যে তারে সবকিছু বলে
পুরষ্কারের কথা বলে যেন প্রলুব্ধ করে তোলে।
তার কল্যাণে তুষ্ট করবে প্রেয়সী বাদীর দিল্
তার ওসিলায় সহজ হইবে যাবতীয় মুশকিল ।
গবীর বেচারা স্বর্ণ-রূপার কথা শুনিবার পর
অর্থের লোভে ছাড়িয়া আসতে রাজি হবে বাড়িঘর ।
টাকাপয়সায় জ্ঞান-বুদ্ধিকে আসক্ত করে ফেলে
গরীব লোককে লজ্জায় মারে অর্থের মোহে পেলে।
ধন সম্পদে যদিও বুদ্ধি কখনো কখনো বাড়ে
বিচক্ষণের জন্যই এটা, সবার জন্য না রে ।


বাদশা যখন চিকিৎসকের শুনলো এসব কথা  
এই নসিহত গ্রহণ করেন, দেখাইয়া মান্যতা ।
বাদশা বলেন, সব কাজ হবে আপনার কথা মত
যাকিছু করতে বলবেন আমি সর্বদা অনুগত ।


স্বর্ণকারের জন্য সমরকান্দে লোক প্রেরণ:—


চিকিৎসকের নির্দেশ মত জ্ঞানী ও বিচক্ষণ
সমরকান্দে পাঠিয়ে দিলেন তখনই দুইজন ।
প্রেরিত লোকেরা সেই শহরের দ্বারে গেল পৌঁছিয়া
স্বর্ণকারের নিকটে হাজির শুভ সংবাদ নিয়া ।
কাজে সুদক্ষ ওস্তাদ ওহে সুনিপুণ কারিগর
তোমার সুখ্যাতি ছড়িয়ে গিয়েছে সমস্ত দেশ ভর ।
অমুক বাদশা তোমাকে ডেকেছে গড়তে অলঙ্কার
তোমার মতন কারিগর নাই, এই যুগে কেউ আর ।
এই নাও রাখো বাদশার দেওয়া অমূল্য উপহার
বাদশার কাছে পৌঁছালে তুমি মেহমান হবে তার ।


ধন সম্পদ, উপহার দেখে ভুলে গেল পিছুটান
ভুললো স্বদেশ ছিন্ন করলো আত্মীয়, সন্তান ।
প্রফুল্ল মনে যাত্রা করলো দুজনের পিছুপিছু
জীবননাশের পথে আগাচ্ছে বুঝলোনা তার কিছু ।
প্রফুল্ল মনে দ্রুতবেগে চলে ঘোড়ার উপর চড়ে
সে তার প্রাণের বিনিময়ে রাজ উপহার মনে করে ।
স্বর্ণকার তো পরমানন্দে নিজের জীবনটাকে
ঠেলিয়া দিচ্ছে স্বেচ্ছায় তার অপমৃত্যুর পাকে ।
রাজকীয় শান সম্মান তার কল্পনা জুড়ে ভাসে
এসব দেখিয়া আজরাইলও বিদ্রুপ করে হাসে ।


পথ পাড়ি দিয়ে পড়লো যখন রাজদরবারে ঢুকে
স্বর্ণকারকে হাযির করলো বাদশার সম্মুখে ।
বাদশার কাছে স্বর্ণকারকে খুশি মনে যায় নিয়া
বাদীর জন্য স্বর্ণকারকে দেওয়া হবে জ্বালাইয়া ।
বাদশা তাহাকে দেখিবামাত্র করলো সম্মানিত
সোনা-ভাণ্ডার সামনে তাহার রাখা হলো অগণিত ।
নির্দেশ দিল সব সোনা দিয়ে বানাও গলার হার
হাতের কাঁকন, পায়ের মল ও কোমরবন্ধ আর ।
বাদশার এই শাহী মহলের সোভা বৃদ্ধির তরে
আরো কতিপয় বালা ও পেয়ালা যেন সে তৈরি করে ।


স্বর্ণ লইয়া স্বর্ণকার তো হইলো কর্মরত
বাদশার সব দুরভিসন্ধি ছিল না যে অবগত ।
চিকিৎসক সে কথা বলছিল বাদশাপনার সাথে
বাদীকে সপিয়া দিন তবে এই স্বর্ণকারের হাতে ।
তার সাথে বাদী মিলিত হইয়া হইবে আনন্দিত
মিলন বারি সে বিরহী আগুন করবে নির্বাপিত ।
স্বর্ণকারকে প্রদান করেন সেই চাঁদমুখী বাদী
মিলনকামী সে প্রেমিকদ্বয়কে বন্দিত করে সাদী ।
ছয়মাস তারা মিলনের স্বাধ করছিল উপভোগ
এমন কি ওই বাদী মেয়েটির সেরে গেলো সব রোগ ।


তখন হেকিম স্বর্ণকারকে শরবত দেয় করে
শরবত পানে চেহারার রঙ কুশ্রী হইয়া পড়ে ।
রোগের কারণে স্বর্ণকারের রূপ গেল সব ঝরে
ম্লান হয়ে গেল তার প্রতি যত ছিল প্রেম পিঞ্জরে ।
ফেঁকাসে চেহারা হইলো তাহার এখন সে কুৎসিত
মেয়েটির মনে স্বর্ণকারের প্রেম তাপ ক্রমে শীত ।
প্রেম-ভালোবাসা শুধু রূপ দেখে মোহে আবদ্ধ হয়
এর শেষ ফল লজ্জিত হওয়া, ইহা খাঁটি প্রেম নয় ।
আহা! যদি প্রেম স্থানী হইতো তবুও তো এক কথা
স্বর্ণকারের রূপক প্রেমের পেলো না তো পূর্ণতা ।


খুন প্রবাহিত হইতে লাগলো তাহার চক্ষুদ্বয়ে
রূপ হলো তার প্রানের শত্রু, কাঁদছে তারই ভয়ে ।
দেখো, ময়ূরের শত্রু স্বয়ং নিজের পালক হায়
বহু বাদশাকে ধ্বংস করলো, তাদেরই ক্ষমতায় ।
রোগাক্রান্তে শোচনীয় হয়ে পড়িলো স্বর্ণকারে
কলমের মতো ক্ষীণ, কৃশদেহী হয়ে গেল একেবারে ।
বলতে লাগলো অবস্থা মোর ওই হরিণের মত
যার মৃগনাভি কেটে নিতে সবে করে ওর দেহ ক্ষত ।
বনের মধ্যে ঘোরাফেরা করা শৃগালের মত ওরে
মাথাটা কাটলো শুধুই আমার চামড়া নেবার তরে ।


শোন ওহে সবে, আমি ওই হাতী নিদারুণ অসহায়
যার হাড় নিতে রক্ষক নিজে আঘাত করিয়া যায় ।
যার লাগি মোরে হত্যা করছে সে কি দামী বহুগুণ
সে কি জানে না যে, শায়িত থাকবে না কভু আমার খুন ।
আমার উপরে বিপদ আসিয়া পড়লো এমনভাবে
আমার মতন ব্যক্তির খুন কি করে বিফলে যাবে ।
প্রাচীরের ছায়া প্রথমে ছড়িয়ে দূরে হয় প্রসারিত
আস্তে আস্তে কাছে এসে ছায়া হবে যে সঙ্কুচিত ।
এই দুনিয়াটা পাহাড়ের ন্যায় কাজগুলো সব ধ্বনি
ধ্বনির পরেই সৃষ্টি হইয়া আসে যে প্রতিধ্বনি ।


এতটুকু বলে স্বর্ণকারের বের হয়ে গেল প্রাণ
বাদীও বিরহ যন্ত্রণা থেকে পাইলো পরিত্রাণ ।
মরণশীলের প্রেম কভু নাহি স্থায়ী হয় নীড়ে
মৃত ব্যক্তিরা কখনো তো আর আসতে পারে না ফিরে ।
চিরঞ্জীবের প্রেমেই সজীব হরদম অন্তর
সদ্য ফোটা সে ফুলের চেয়েও টাটকা অধিকতর ।
হে প্রেমিক কুল, মহান প্রিয়র প্রেমে পড়ো সব ভুলে
পরমানন্দে মহব্বতের শরাব দিবেন তুলে ।
সেই পবিত্র সত্তার প্রেম হৃদয়ে ধারণ করো
যার ওসিলায় আম্বিয়াগন মর্যাদাবান বড় ।


ভেবো না সেই সত্তার কাছে পৌঁছাই যে কি করে
মেহেরবানের কাছে পৌঁছাবে মেহেরবানীর জোরে ।


(মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি রহ.-এর অমর গ্রন্থ মসনবী শরীফ থেকে অনুদিত)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ ৬+৬+৬+২