আহ্নিক গতি বার্ষিক গতির মতোই নিয়তির চাকা প্রতি নিয়তই প্রবাহমান। আর সেই সঙ্গে হতে থাকে কিছু কিছু পরিবর্তন। এমন কি কিছু প্রাণী বা উদ্ভিদ লুপ্তও হতে থাকে। যেমন এই পৃথিবীর  বুকে একসময় অবাধ বিচরণ ছিল ডাইনোসরাস, ড্রাগনের মতো বিশালকায় জীব যা আজ লুপ্ত। তা বলে সম্পর্ক বা দৈনন্দিন জীবনের গতি প্রকৃতিও লুপ্ত হবে এই বিশ্বাস কীকরে করতে পারি। কিন্তু এও সম্ভব। আসরের প্রিয় কবি রণজিৎ মাইতি মহাশয় "এখন যেমন দিন" কবিতায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। প্রজাতি, ভাষা বা সম্পর্কও লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
  এখানে আমার একটা নিজস্ব অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। বেশ কিছু দিন আগের কথা। কোলকাতা থেকে প্রায় ৪০০কিমি দূরে পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাড়া গ্রামে আমার আবাস। সামনেই আছে কয়েকটি পাহাড়। প্রতি বৎসর কোলকাতা থেকে কয়েকটি গ্রুপ কিছু ছাত্র ছাত্রী নিয়ে এখানে ৭দিন বা ১০দিনের জন্য আসে। পাহাড়ের তলদেশে তাঁবুতেই উক্ত কয়েকদিন কাটায়। উৎসুক হয়ে আমরা তাদের দেখার চেষ্টা করতাম। দেখলাম একজন শিক্ষিকা ছাত্র ছাত্রীদের পাথরের সাথে পরিচয় করাচ্ছেন। -"এটিকে পাথর বলে, এটা পাহাড়, ওটা পুকুর" আর প্রায় ১০/১২ বৎসরের ছেলে মেয়েরা আশ্চর্য হয়ে সেই সকল দেখতে চাইছে। সঙ্গে আমিও আশ্চর্য হচ্ছি এটা ভেবে যে এরা এগুলোও জানে না!
   এরপরে কবির কবিতাটি দেখা যাক।


"দেখছি নিম্নচাপে হারিয়ে যায় ভরা ডিসেম্বর
এভাবে কিছু প্রজাতি,ভাষা, সম্পর্ক.."


জলবায়ুর পরিবর্তনে রাষ্ট্রসংঘের কপালে ভাঁজ। এ কথা সকলেই জানেন। কবি এই কথাটি ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইলেন ডিসেম্বর মাস যখন কি না প্রচন্ড শীত লাগার কথা তখন পৃথিবীতে নিম্নচাপ চলছে। আর বর্ষাকালে প্রচন্ড দাবদাহে কৃষকের মাথায় হাত। এই ভাবেই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি আর হারিয়ে যাচ্ছে কিছু প্রজাতি সে জীব জগতেই হোক বা মানব জাতিই হোক। অন্য ভাষার প্রতি আকর্ষণে নিজের ভাষা হয়ে যাচ্ছে দ্বিমিশ্রিত। সম্পর্ক হয়ে যাচ্ছে তিক্ত।


"এখন ফ্ল্যাট বাড়ির চারদেওয়ালের ঘেরাটোপে
বর্ণপরিচয়ের সাথে পরিচয় হয়--
চ-এ চড়ুই
শ-এ শকুন "


আমি যে অভিজ্ঞতার কথা বললাম শহর থেকে ৪০০ কিমি দূরে গিয়ে পরিচয় করাতে হচ্ছে "এটিকে পাথর বলে,এটা পাহাড়"। কবি সেই কথাই বলতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তাঙ্গনে আম্রকুঞ্জে শিক্ষার ভাবনা আর কই। চার দেওয়ালের মধ্যে চড়ুই কি জাতীয় প্রাণী তার আকার কতটা শিশুরা কি বুঝবে। তেমনি শকুন আজ লুপ্তপ্রায়। কি ভাবে সেই শিশুকে বোঝানো যাবে শকুন জন্তু, জানোয়ার না খেচর।
  শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে গ্রীষ্মের অনুভব কি করে করবে? কিছু অর্থবান মানুষের সকাল থেকে রাত্রি অবধি এ. সি সুবিধা ভোগ করেন। বাথরুমে ঠাণ্ডা গরম জলে স্নান, এসি গাড়িতে অফিস, অফিসে এসি, বাড়িতে ফিরে সম্পুর্ণ এসি ঘর, ভ্রমণে গেলে  ট্রেন বা প্লেন এসি, হোটেলে রুম এসি। তাঁরা কি করে বুঝবে শরৎ আর হেমন্তের ফারাক।
   কবি আর একটা দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন তা হলো সম্পর্কও হারিয়ে যাচ্ছে। যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। বৃদ্ধ মা বাবার ছবি বড় করে দেওয়ালে টাঙিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি এরপর নিজের সন্তানদের সেই ছবি দেখিয়ে দাদু দিদার স্বরূপ পরিচয় করাতে দ্বিধা বোধ করি না। তেমনি আর্থিক ভাবে দুর্বল কোন নিকট আত্মীয়কে অবজ্ঞা করে চলি আর আর্থিক ভাবে সচ্ছল কোন দূর সম্পর্কিত আত্মীয়কে নিকট আত্মীয় বলে পরিচয় করায়।
  কবির মধ্যে মানবিক বোধ বারবার আঘাত করে। তিনি দুশ্চিন্তা অনুভব করেন "এখন যেমন দিন" চলছে তা সত্যি বিষাদময়। কবি মানুষের সংজ্ঞা নির্ণয়ে ব্যর্থ হন। বর্তমান সময়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে লুপ্তপ্রায় মানসিকতা নিয়ে "এখন যেমন দিন" নামকরণ সহ একটি সার্থক মানবিক বোধের রূপক কবিতা।
শ্রদ্ধেয় কবির মানসিকতায় আরো বেশী কিছু থাকতেই পারে আমার সামান্য জ্ঞানে যতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি তা সবার সামনে তুলে ধরলাম। প্রিয় কবির মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম। এমন একটি কবিতা আসরে উপহার দেওয়ার জন্য শ্রদ্ধেয় কবিকে জানায় আন্তরিক ধন্যবাদ ও শুভকামনা।