কাকে বলা যায় গদ্য কবিতা?


নীলাঞ্জনছায়া,      প্রফুল্ল কদম্ববন,
জম্বুপুঞ্জে শ্যাম বনান্ত,    বনবীথিকা ঘনসুগন্ধ॥
মন্থর নব নীলনীরদ-    পরিকীর্ণ দিগন্ত।
চিত্ত মোর পন্থহারা    কান্তবিরহকান্তারে॥


কবিতাটি বিশুদ্ধ গদ্যে লেখা।রবীন্দ্রনাথের ভাষার জাদুতে ব্যাপারটা আমরা খেয়াল করিনা।চারটি বাক্য, কিন্তু একটিও ক্রিয়াপদ নেই। ছন্দ নেই, কিন্তু বুকের মধ্যে একটা তাল দিয়ে অনুভব করা যায়। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে গদ্য কবিতা, কিন্তু কানের ভেতরে কবিতার মতো কাজ করে।একেই বলে আধুনিক গদ্য কবিতা। মিল নেই অথচ মিলের আবহ ঘনিয়ে উঠেছে যুক্তব্যঞ্জনের অনুপ্রাস দিয়ে।গদ্য কবিতা হলেও শোনাচ্ছে কবিতার মতো। কবিতাটি বারবার পড়লে ঘনবর্ষার মেঘ নিবিড় হয়ে ওঠে বুকের মধ্যে।রবীন্দ্রনাথের উৎকৃষ্ট শব্দের জাদু আমাদের এমন এক জায়গায় উড়িয়ে নিয়ে যায়, যার ভাষাপ্রয়োগ আমাদের সে জায়গায় পৌঁছতে দেয়না।আধুনিক কবিতার এক শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে এই কবিতাটির মাধ্যমে।


এবারে কবি কালিদাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূল পার্থক্য টা দেখুন :


কালিদাস :
তোমায় সাজাবো যতনে
কুসুমে রতনে
কেয়ূরে কঙ্কনে কুমকুমে চন্দনে


রবীন্দ্রনাথ:
সখিরে সাজাবো সখার প্রেমে


সখীকে যে প্রেম দিয়ে সাজানো যায় কবি কালিদাসের কাছে তা ছিল কল্পনার বাইরে ।


আরো একটা উদাহরণ :
'বাঁধিনু যে রাখি পরানে তোমার'।


পরানে যে রাখি পরানো যায় তা চন্ডিদাস-বিদ্যাপতির চিন্তাধারার বাইরে ছিল।


আরো একটি :
সেদিন বাতাসে ছিল তুমি জানো
আমারি মনের প্রলাপ জড়ানো
আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো
তোমার হাসির তুলনা


এলোমেলো বাতাসের সঙ্গে মানুষের অসংলগ্ন চিন্তার তুলনা বা আকাশের আলোর সঙ্গে প্রেয়সীর হাসির তুলনা,এই দুটি বিষম বস্তুকে একটি অবর্থ্য উপমায় মিলিয়ে দেবার এই ক্ষমতা আধুনিক কবিদের আগেও ছিলোনা আর এখনো নেই।


আমাদের প্রাণের চিরচেনা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের অপ্রত্যাশিত ভাবে আধুনিকতার সুর এসে লাগে আমাদের মনে।


আধুনিক কবিরা যারা রবীন্দ্রবিরোধী, একবার ভেবে দেখার সময় হয়েছে তাদের।