পুরাণ অনুসারে, দুর্গা যেমন অসুরবিনাশী দেবী, তেমনি তিনি দুর্গতিনাশিনী, যিনি জীবের দুর্গতি নাশ দেবী দুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর এই জয়ের মধ্য দিয়ে অন্যায় ও অশুভর বিরুদ্ধে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল।


পুরাণ অনুসারে, রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তাঁরা দেবী দুর্গার পূজা করেন। দেবীর বরে তাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়।


স্মরণ করেছেন, "সিংহস্থা শশীশেখরা মরকতপ্রেক্ষাঃ চতুর্ভিভুজৈঃ, শঙ্খং চক্র ধনু শরাংশ্চ দধতিনেত্রৈঃ স্থিভিঃশোভিতা, আমুক্তাঙ্গদ হারকঙ্কন রণংকাঞ্চী কন্বংনূপুরা -দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী, ভবতুয়ো রত্নোলস্যত্কুোন্তলা।"


প্রতি পদক্ষেপে মহামায়া দুর্গাকে স্মরণ করেছেন - "ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরণন্তবীর্যা/বিশ্বাস্য বীজং পরমাসি মায়া/সম্মোহিতং দেবি সমস্তশেতত্‍/ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি-সিদ্ধিহেতুঃ।।"


মা সিংহবাহিনী, তোমার শক্তি, তোমার বীর্য অনন্ত অপার। তুমিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের জগত্পাহলিনি শক্তি। এই ব্রহ্মাণ্ডের তুমি আদির আদি কারণ মহামায়া। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডজগত্কো মোহগ্রস্ত করে রেখেছ; কিন্তু তুমি প্রসন্না হলে শরণাগত মুক্তিসিদ্ধি লাভ করে। এই হল বোধনের আদি মন্ত্র।


'বোধন' শব্দের ব্যুত্পনত্তিগত অর্থ হল 'বোধ'-এর 'অনট্' ধাতু - অর্থাত্‍ জাগ্রত করা - অপরা জগতের 'ধী'শক্তি দিয়ে পরাজাগতিক মহাশক্তিকে বোধিত্বে অর্থাত্‍ জাগ্রত অবস্থায় অধিষ্ঠিত করা, প্রতিষ্ঠিত করা।


পরবর্তী যুগে অর্থাত্‍ ত্রেতা যুগে রাবণও চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার বোধন এবং আরাধনা করতেন। কিন্তু রামায়ণের কাহিনি অনুসারে লঙ্কা থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য যে রাম-রাবণের অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ, সেখানে রাবণকে বধ করার জন্য রামচন্দ্রকে দেবীর শরণাপন্ন হতে হয়। দেবাদিদেব মহাদেবকে কঠোর তপস্যায় তুষ্ট করে রাবণ বর লাভ করেছেন। দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের একনিষ্ঠ সাধক ও পূজারি হলেন রাবণ। যুদ্ধক্ষেত্রে মহাকালী স্বয়ং রাবণকে নিজের কোলে স্থান দেন। এ হেন রাবণকে বধ কী করে হবে


রামকে দেবীর নির্দেশের কথা বললেন ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। যদিও সময়টা শরত্কা ল - রামচন্দ্র নিজের হাতে দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করে পুজো করলেন, অকালে বা অসময়ে প্রকট হওয়ার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন।


ব্রহ্মা স্বয়ং দুর্গার বোধনপূজা করেন। পূজার প্রারম্ভে স্বয়ং প্রজাপতি পদ্মযোনি ব্রহ্মা দেখেছিলেন সাগরের বালুকাবেলার অনতিদূরে গভীর অরণ্যের প্রান্তসীমায় একটি বিল্ববৃক্ষের নীচে একটি আট থেকে দশ বছরের বালিকা আপন মনে খেলছে। ব্রহ্মা ধ্যা্নস্থ হয়ে জানলেন, সেই বালিকাই স্বয়ং গৌরী - কন্যকা। ব্রহ্মা চোখ মেলতেই সেই বালিকা ওই বিল্ববৃক্ষে লীন হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মা স্থির করলেন, দেবী দুর্গার সেই বোধনের পূজার্চনা হবে ওই বিল্ববৃক্ষের নীচে। তাই আজও দেবীর বোধনের পূর্বে বিল্বশাখা বা বিল্ববৃক্ষকে পূজা করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হয় দেবীর মৃন্ময়ী বিগ্রহের মহাঘটে। শুরু হয় 'বোধন'-এর আরাধনা, বেজে ওঠে শঙ্খ, ঢাক।


তাই বোধন হল মহাপূজায় দেবী মা দুর্গার প্রারম্ভিক আবাহন, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পরম্পরাগত ভাবে প্রবহমান। বসন্তকালের সঙ্গে ত্রেতা যুগে যুক্ত হল শরত্কাাল - অর্থাত্‍ অকালে হল দেবীর বোধন, তাই এ হল অকালবোধন।


উচ্চারণ করি বোধনের মন্ত্র
রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানু গ্রহায় চ/অকালে ব্রহ্মনা বোধো দেব্যাস্ত্বয়ি কৃতঃ পুরা। অহমপ্যাশ্বিনে ষষঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামি বৈ।।


ষষ্ঠী তিথিতে দুর্গার বোধন সপ্তমীতে মূতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা। অষ্টমী ও নবমীতে মহাপূজা ও দশমীতে দেবীর বিসর্জন। এই পূজার বিশেষত্ব হল সন্ধিপূজা অষ্টমী ও নবমী তিথির মিলনক্ষনে সন্ধিপূজা।
শারদীয়া দুর্গাপূজা জাতীয় জীবনে সর্বাঙ্গীন। তাই বাংলা কবিতা আসরের সকল  কবি ও সহৃদয় পাঠকবৃন্দকে জানাই শারদীয়া দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিগণের জয় হোক। শুভ মহালয়া! জয়গুরু!!!


দেবী বন্দনা ও মহালয়ার স্তোত্রপাঠ
কণ্ঠে ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


(ঊষালগ্নে বেজে ওঠে শঙ্খধ্বনি, তত্সহ সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা)


[সঙ্গীত]


জাগো... তুমি জাগো...
জাগো দুর্গা জাগো দশভূজা দশপ্রহরণধারিণী
চণ্ডিকা শঙ্করী তুমি জাগো---
জাগো অসুরবিনাশিনী তুমি জাগো...


[গীতাংশ]


তুমি দুর্গা, তুমি মা কালী, তুমি তারা, চণ্ডিকে!
বিশ্বজুড়ে বিরাজিছ মাগো তুমি কল্যাণকারিকে!
তুমি মা শক্তি তুমি মা ভক্তি,
তুমি মহামায়া, আদ্যাশক্তি,
তব বন্দনায় বাজে জয়ঢাক, শঙ্খঘন্টা দিকেদিকে>
তুমি দুর্গা চণ্ডিকে.....
তুমি দুর্গা, তুমি মা কালী, তুমি তারা, চণ্ডিকে!
তুমি কল্যাণকারিকে!
বিশ্বজুড়ে বিরাজিছ মাগো তুমি কল্যাণকারিকে!
তুমি দুর্গা চণ্ডিকে................


[স্তুতিপাঠ]


ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষটকার স্মরাত্মিকা।
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যা, ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।
অর্দ্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচর্যা বিশেষতঃ।
ত্বমেব সন্ধ্যা সাবিত্রী ত্বং দেবী জননী পরা।।
ত্বয়েতোধার্যতে বিশ্বং ত্বয়েং সৃজ্যতে জগত।
ত্বয়েত্পাল্যতে দেবী ত্বমস্যন্তে চ সর্ব্বদা॥


[স্তোত্রপাঠ]


দেবী দুর্গা! সচেতন চিন্ময়ী।
তিনি নিদ্রা, তাঁর আদি নেই
তাঁর প্রাকৃত মূর্ত্তি নেই।
বিশ্বের অনন্ত প্রকাশ তাঁর মূর্ত্তি।
নিষ্কাসিত অসুর পীড়িত দেবতারক্ষণে
তাঁর আবির্ভাব হয়।
দেবীর শাশ্বত অভয়বাণী-
ইচ্ছং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি
তদা তদা অবতীর্যাহং করিষ্যামি অরি সংক্ষয়ম।


[ভাষ্যপাঠ]


পূর্বকল্প অবসানের পর প্রলয়কালে, সমস্ত জগত যখন কারণ সলিলে পরিণত হল, ভগবান বিষ্ণু অখিল প্রভাব সংহত করে সেই কারণ সমুদ্রে রচিত অনন্ত শয্যাপরে যোগ নিদ্রায় হলেন অভিভূত। বিষ্ণুর যোগনিদ্রার অবসানকালে তাঁর নাভিপদ্ম থেকে জেগে উঠলেন আদিকল্পের সৃষ্টবিধাতা ব্রহ্মা। শ্যামশক্তিমান বিশ্বত্রাতা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য হরিনেত্র নিবাসিনী নিরুপমা ভগবতীকে ঋকমন্ত্রে করলেন অভিবন্দনা।


[মন্ত্রপাঠ]


নমঃ দেবৈ মহাদেব্যৈ শিবায়ৈ সততং নমঃ
নমঃ প্রকৃতায়ৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তা প্রণতাস্ম তাম।
রৌদ্রায়ৈ নমঃ নিত্যায়ৈ গৌর্যৈ ধাত্রৈ নমো নমঃ।
জ্যোত্স্নায়ৈ চেন্দু রূপিনৈ সুখায়ৈ সততং নমঃ॥
অতিসৌম্যাতি রৌদ্রায়ৈ নতাস্তস্যৈ নমো নমঃ।
নম জগত্প্রতিষ্ঠায়ৈ দৈব্যৈ কৃত্যৈ নমো নমঃ॥


যা দেবী সর্বভূতেষু চেতন্যভিধীয়তে,
নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমো নমঃ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা,
নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমস্তসৈঃ নমো নমঃ॥


[শান্তিজল প্রদান মন্ত্র ]


ঔঁ দ্বৌ শান্তিঃ অন্তরীক্ষং শান্তিঃ পৃথিবীং শান্তিঃ শান্তি রাপ শান্তি রোষধয়, শান্তিঃ শান্তিরেব। শান্তি সামা শান্তিরেধি। ঔঁ আপদং শান্তিঃ যত্র এবাগত পাপং তত্রৈব প্রতিগচ্ছতু।
ঔঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।


দেবী আবাহনী কবিতা (মহালয়ার কবিতা)
কলমে – কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


মহালয়া হতে আজি  শুরু দেবীপক্ষ,
স্বর্গ মর্ত্য রসাতলে জাগে যক্ষ রক্ষ।
মহিষাসুর করিলা স্বর্গ অধিকার,
দেবগণ তথা হতে কৈলা বহিঃষ্কার।


ভয়ে ভীত দেবগণ করিল মন্ত্রণা,
অসুর নিধন তরে ধায় দেবসেনা।
দেবতাগণ অসুর সাথে রণ করে,
সহস্র সহস্র সেনা রণভূমে মরে।


ব্রহ্মা বরে বলীয়ান সে মহিষাসুর,
স্বর্গ হতে দেবগণে করিলেন দূর।
দেবগণ অস্ত্র দেন দেবীরে তখন,
ত্রিশূল লইয়া দেবী করে আগমণ।


মহিষাসুরে বধিলা ত্রিশূল ধারিণী,
অসুর বধিয়া দেবী মহিষ-মর্দিনী।
মহিষ-মর্দিনী নাম তাহার কারণ,
মহালয়া মহাকাব্য লিখিল লক্ষ্মণ।