কালী কালী মহাকালী দেবী আগমনী…..শুভ দীপাবলীর
আগমনী স্তবগাথা- অষ্টম পর্ব
তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা ও স্তোত্রপাঠ-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


দুর্গাপুজোর পর আসে কালীপূজা। এই কালীপুজো-কে ঘিরে মেতে ওঠে সবাই। শক্তির আরাধনায় দেবীপূজা করে মর্ত্যবাসী। অসুরদের বিরুদ্ধে মা-কালীর বিজয়কে উৎসর্গ করে এই আরাধনা হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। কালীবন্দনার মূলেই রয়েছে অশুভ শক্তিকে হারিয়ে শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা।
অসুরদের সঙ্গে ঘোর প্রলয়ঙ্কর লড়াই-এ নেমেছিলেন মা-কালী। চারিদিকে তমসাচ্ছন্ন, মা-এর সেই রুদ্রমূর্তিতে দিশেহারা অসুরদের দল। চণ্ডালিনী মূর্তির সেই গ্রাসে একে একে নিঃশেষ হয়ে যায় অসুরদের দল। কালীর এই রূপ-কে নিয়ে রয়েছে বহু পৌরাণিক কথা।


কালী কেন শক্তির দেবী


শক্তির দেবী হিসাবেই কালী পূজিত হন। সনাতন ধর্ম-মতে এর উল্লেখ মেলে। কালী-নাম মাহাত্ম্যে কাল-কে যদি আলাদা করে নেওয়া হয় তাহলে কাল-এর একাধিক অর্থ বের হয়। কাল মানে সময়, আবার কাল তথা কৃষ্ণবর্ণ। কাল-এর অর্থ-এ লুকিয়ে আছে সংহার- বা মৃত্যু ভাবনাতেও। কালীকে কাল অর্থাৎ সময়ের জন্মদাত্রী বলা যেতে পারে, আবার পালনকর্ত্রী এবং প্রলয়কারিণী নিয়ন্ত্রক বলা হয়। এবং সেই কারণেই দেবীর নাম কাল যুক্ত ঈ-কালী। সনাতন ধর্মে ঈ-কারের সৃষ্টি ও শব্দোচ্চারণ-কে উল্লেখ করা হয়েছে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নিগুর্ণ ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করার জন্য। আবার শ্রীশ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ মেলে যে, ‘যা দেবী সর্বভুতেষু চেতনেত্যাবিধীয়তে, নমস্তসৈ, নমস্তসৈ নমো নমোঃহ।’ এই কারণে অনেকেই কালী-কে ক্রোধাম্বিতা, রণরঙ্গিনী বা করালবদনা বলেও অভিহিত করে থাকেন।


‘কালী’ নাম কেন


কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ হল কালী। আর শিব-কেও কাল নামে ডাকা হয়। কাল মানে অনন্ত সময়। এই সময়েরই স্ত্রীলিঙ্গ বোধক হচ্ছে কালী। শাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে যে কাল সর্বজীবকে গ্রাস করে, সেই কালকে আবার যিনি গ্রাস করেন-তাঁকেও কালী বলা হয়। জগতের উৎপত্তি, স্থিতি, মহাপ্রলয়-এর পিছনে রয়েছে কালশক্তি। সবচেয়ে মজার কথা এই সবের জন্য যে মহাকাল পরিস্থিতির উদ্ভূত হয় তাই আবার সব সৃষ্টিকে গ্রাস করে। সনাতন ধর্মে উল্লেখ যে মহাকালেরও পরিণাম আছে। মহাপ্রলয়ের কালশক্তি মহাকালীর ভিতরেই নিঃশেষ লীন হয়ে যায়।


কালী-র জন্ম


স্বর্গ তোলপাড় করে লন্ডভণ্ড করে দিচ্ছে অসুরের দল। দেবতাদের তাড়িয়ে স্বর্গরাজ্যের দখলের চেষ্টাও করছে তারা। দেবতাদের মধ্যে ত্রাহি-ত্রাহি রব। অসুরদের প্রধান রক্তবীজ-এর ছিল ব্রহ্মার বর। যার জেরে রক্তবীজের শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত ভূতলে পতিত হলেই তা থেকে জন্ম নিচ্ছিল একাধিক অসুর। এমন পরিস্থিতি থেকে স্বর্গ-কে রক্ষা করতে এবং দেবতার মানসম্মান রক্ষার্থে অবতীর্ণ হন দেবীদুর্গা। সব অসুর দেবীদুর্গার হাতে নিহত হলেও ব্রাক্ষ্মার বরপ্রাপ্ত রক্তবীজ বারবার বেঁচে যায়। ক্রোধাম্বিত দেবীদুর্গা তাঁর ভ্রু যুগলের মাঝ থেকে জন্ম দেন কালী-কে। কালীর ভয়াবহ রুদ্রমূর্তি আর নগ্নিকা রূপে নিহত হতে থাকে একের পর এক অসুর। রক্তবর্ণ লকলকে জিভ বের করে কালী গ্রাস করে নিতে থাকেন একের পর অসুর এবং তাদের রণবাহিনীকে। হাতি, ঘোরা সমতে অসুরের দলকে কালী গ্রাস করতে থাকেন। রক্তবীজকে অস্ত্রে বিদ্ধ করে তার শরীরের সমস্ত রক্ত পান করে নেন কালী। রক্তবীজের শরীর থেকে একফোঁটা রক্ত যাতে মাটিতে না পরে সেজন্য কালী তাকে শূন্যে তুলে নেন। রক্তবীজকে এক্কেবারে রক্তশূন্য করে দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেন।


কালীর পা-এর তলায় শিব কেন


অসুরদের হারানোর পর প্রবল বিজয়নৃত্য শুরু করেন কালী। অসুরের ধরহীন মুণ্ড দিয়ে বানান কোমড়বন্ধ ও গলার মালা। কালীর উন্মাদ নাচে স্বর্গে তখন ত্রাহি-ত্রাহি রব। দেবতারা ফের ছুটলেন মহাদেবের কাছে। কারণ কালীর নৃত্যে সৃষ্টির লয় ধ্বংস হওয়ার পরিস্থিতি। ছুটলেন মহাদেব কালীর নাচ বন্ধ করতে। কিন্তু, মহাদেবের হাজারো কথাও শুনতে পেলেন না উন্মাদিনী কালী। উপায়ান্ত না দেখে মহাদেব এবার কালীর পা-এর তলায় নিজেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। পায়ের নিচে স্বামীকে পরে থাকতে দেখতে লজ্জিত হন কালী। লজ্জায় জিভ কাটেন তিনি। পৌরাণিক এই কাহিনি অবলম্বনে পূজিত হয়ে আসছেন কালী। তাই কালীরূপ মানেই তাঁর নগ্ন-রূপ আর অসুরদের ধরহীন মুণ্ড-র কোমরবন্ধনী ও মালার সঙ্গে সঙ্গে পা-এর তলায় শিব।


তাই কালী মাকে ডাকার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম হয় না। ভক্তিই হল মূল মন্ত্র। তবে বৈদিক মতে পুজো-অর্চনার তো বিধিবদ্ধ নিয়ম আছেই। তা ছাড়া কালীপুজোর দিন পুজোর জন্য উপবাস থেকে জপতপ ইত্যাদির সুফল পাওয়া যায়। মা কালী সময়ের প্রতীক। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার জন্য।


মা কালীর চিত্র বা মূর্তির সামনে বিভিন্ন পুজোর দ্রব্যাদি-সহ সহজ প্রার্থনার কিছু মন্ত্র-


প্রদীপ বা মোমবাতি প্রদানের মন্ত্র-
‘এষ দীপ ওম ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ।’


ধূপকাঠি প্রদানের মন্ত্র-
‘এষ ধুপঃ ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ।’


কর্পূর প্রদানের মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ আরাত্রিকম্ সমর্পয়ামি।’


দুধ-স্নানাদি প্রদানের মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ পয়স্নানাম্ সমর্পয়ামি।’


দই-স্নানাদি প্রদানের মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃদধিস্নানাম্ সমর্পয়ামি।’


পঞ্চামৃত-সহ স্নানের দ্রব্যাদি প্রদানের মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ পঞ্চামমৃত স্নানম্ সমর্পয়ামি।’


গঙ্গাজল স্নানের প্রদানের মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ গঙ্গাস্নানম্ সমর্পয়ামি।’


পঞ্চফল প্রদানের মন্ত্র-
‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ পঞ্চফলম্ সমর্পয়ামি।’


পুষ্প প্রদানের মন্ত্র-
‘এষ গন্ধপুস্পে ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ।’


প্রণাম মন্ত্র-


‘ওঁ ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হিং হিং দক্ষিণে কালীকে
ক্রীং ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হ্রীং হ্রীং হ্রীং স্বাহা।
ওঁ কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণী
ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে।’


এরপর জপ একশো আটবার করা যায় এই মন্ত্রে- ‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ।’


মা আসছেন। শ্যামা মায়ের আগমনে দিকে দিকে কালো অন্ধকার মুছে যাক। দীপাবলীর উজ্জ্বল আলোকমালায় ভরে উঠুক চতুর্দিক। তাই দিকে দিকে চলছে পূজার প্রস্তুতি। সাথে থাকুন, পাশে রাখুন। জয়গুরু!



কালী কালী মহাকালী দেবী আগমনী…..দীপাবলী সংকলন-১৪২৬
দীপাবলীর আগমনী কবিতা-৮ (শ্যামা সংগীত)
কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


খড়্গ তুলে নাও মা কালী নরমুণ্ডমালা গলায় পরে,
মহাকালী রূপটি মায়ের দেখুক সারা বিশ্বচরাচরে।
ত্রিশূল ধরো মা কালী, তুমি যে মা ত্রিশূল-ধারিণী,
কে বলে মা তোমায় কালী তুমি মহিষাসুর-মর্দিনী।


কালরাত্রি মহারাত্রি মা এসো মাগো এ ধরার পরে।
অসুরে ছেয়েছে দেশ এসো অসুরদের নিধন তরে।
কৃষ্ণ-অমাবস্যার ঘন অন্ধকারে, পূজি মা তোমায়,
এসো মাগো এই বসুধায় পূজার সময় বয়ে যায়।


মা যে আমার অন্নপূর্ণা অন্ন দেহ মা তব সন্তানেরে,
হাতে ধরো মা খড়্গ ত্রিশূল বধ করো মা অসুরেরে।
মঙ্গল ঘট সাজিয়ে মাগো পূজিব তোমায় ভক্তিভরে।
ত্রিশূলধারিণী মা যে আমার পুজি মাকে কেমন করে।


ভক্তি ভরে করি পূজা মায়ের মন্ত্র তন্ত্র নাহি জানি,
অন্তিমে মা তব রাঙাপায়ে ঠাঁই যেন পাই মা আমি।