ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- 2020 (অষ্টম পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


ভাদু কাশীপুরের রাজার মেয়ে। বিয়ে ঠিক হয়েছিল বর্ধমানের রাজকুমারের সঙ্গে। বিয়ের দিন বর বেশে যাত্রা পথে রাজকুমারের ম়ৃত্যু ঘটে লেঠেলদের হাতে। ভাদু আত্মহত্যা করেন। অনেকে আবার ভাদুর সঙ্গে মীরাবাই-এর মিল পান। সে খানে রাজকন্যা ভাদু, জন্ম থেকে তিনি মীরার মতো কৃষ্ণভক্তি পরায়ণা।


রাজা তাঁর বিবাহ ঠিক করলে ভাদু মন্দিরে নিজের প্রাণ ধ্যানস্থ অবস্থায় ত্যাগ করেন। কেউ কেউ ভাদুকে বাঁকুড়ার মল্ল রাজাদের কন্যা ভদ্রাবতী বলে মনে করেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে ভাদু পুজোর প্রচলন।


অনেকের মতে সাঁজপুজুনি, পুণ্যিপুকুরের মতো না হলেও এয়োস্ত্রী মহিলাদের শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে সংসার জীবনে সুস্থ থাকার জন্য এ এক ধর্মীয় ব্রত।


কেউ কেউ বলেন ভাদু বীরভূমের সন্তান। তাই বীরভূমে ভাদু পুজোর এত প্রসার। আবার বর্ধমানের সঙ্গে ভাদুর যোগ খুঁজে পান কেউ কেউ। অবিভক্ত বর্ধমানের খনি অঞ্চলে ‘ভাদা গান’ বলে একটি লোক-সংস্কৃতি প্রচলিত ছিল। এখনও কিছু কিছু জায়গায় তার প্রচলন রয়েছে। তার নামে ভাদু পুজো।


উপরের এই সব মত থেকে নানা প্রশ্ন উঠে আসে। যেমন ভাদ্র মাস থেকে কি ভাদু পুজো? সত্যের খোঁজ পাওয়া ভার। কারণ, সব লোক- উৎসবের সঙ্গে মাসের নাম জড়িয়ে থাকে এমনটা নয়।


বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জেলার অধিকাংশ বাড়িতেই ভাদ্র মাস এলেই একটা উৎসব শুরু হয়ে যায়। মহিলা’রা ছোট ছোট দল বেঁধে ভাদু’র মূর্তি নিয়ে এ বাড়ি সে বাড়ি করে বেরাবে। সে মূর্তি’র হাতে থাকবে ধানের শীষ, মিষ্টি, পান, সঙ্গে থাকবে নাচ, গান, আনন্দ আর তলে তলে ভাদু চলে যাওয়ার বেদনাও। চলে যাওয়ার বলছি, কারণ ভাদুকে নিয়ে যত গল্প আপনি শুনবেন, প্রত্যেকটির শেষ হচ্ছে ভদ্রেশ্বরী বা ভদ্রাবতী’র আত্মহনন দিয়ে। মানে যত ক্ষণ রয়েছে, প্রাণোচ্ছ্বল, আর যাওয়ার বেলা, করুণ সুর।


গল্পে আছে, পুরুলিয়া’র কাশিপুর অঞ্চলের রাজা নীলমণি সিংহ খোঁজ পেয়েছিলেন এই ‘সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকুর’-এর। ছোট্ট ভদ্রেশ্বরীতে এমনই মজে গেলেন নীলমণি, যে তাকে মনে মনে রাজকন্যা ভেবে ফেললেন। কিন্তু তার পালক পিতা তো ভদ্রেশ্বরীকে কিছুতেই কাছছাড়া করবেন না, অতএব সে থেকে গেল, ওই গ্রামেই। বড় হয়ে সে প্রেমে পড়ল পাশের গ্রামের অঞ্জনের।


নীলমণি মানস-কন্যাকে আরও ভাল হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, তাই অঞ্জনকে কারাগারে আটক করে রাখলেন। দুঃখিনি ভদ্রেশ্বরী এ বার, দুই সখাকে নিয়ে সারা রাজ্য ঘুরতে লাগল। চোখ খুঁজে চলেছে অঞ্জনকে আর মুখে গান। যদি অঞ্জন এক বার শুনে চিনে ফেলে...যত দিনে অঞ্জনকে মুক্তি দিলেন নীলমণি, তত দিনে ভদ্রেশ্বরী আর নেই, ভাদু হয়ে গিয়েছে, আর তার ওই গান, ভাদু গান।


ওই সব অঞ্চলের রুখা মাটিতে এই ভাদ্র মাসেই আউশ ধান পাকে আর সেই আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে ভাদু পুজো। ধান চাষ করে ঘরে তোলার কাজটা মূলত পুরুষ’রা করলেও, ভাদু কিন্তু নারী-উৎসব। সারা বছরের হাড় ভাঙা খাটুনির পর এই সময়টাই তো খানিক মুখ তোলার অবসর।


আর মুখ তুলে ও দেশের মেয়েরা যা বলেন, তার থোক মানে হল, আজ তাঁদের কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না, এমনকী মরদ’রাও না। আজ শুধুই ‘আনন্দ আর ফুর্তি’। ভাদু গানে বলে ‘ভাদু পুজার দিনে, সারা রাত উড়াব ফুর্তি হে, কাটাব জাগরণে, বাকি আজ রাইখনা কিছু, যা ইচ্ছা মনে, রাখ লোক-লজ্জা, দাও দরজা, মহাপুজা এইখানে...’


যেটা বেশি করে চোখে পড়ছে, তা হল নারী’র মুখের, শরীরেরও, স্বাধীন ভাষা, ভঙ্গি। খেয়াল করলে হয়তো দেখবেন, এই অবস্থা, বছরের অন্য কোনও সময়ে পাওয়া যায় না। এই সময়ে, মহিলা’রা দল বেঁধে উঠোনে জমিয়ে গান বাঁধেন। গান শুরু হয় এক জনের মুখ থেকে, তার পর চক্কর খেতে খেতে যায় অন্যের কাছে, এমনটা চলতে থাকে, যত ক্ষণ না একটা গোটা গান তৈরি হয়ে যাচ্ছে।


গান বানাচ্ছেন মেয়েরাই, কিন্তু এখন ও সব অঞ্চলে গেলে দেখবেন, অনেক চটি বই পাওয়া যায় (অনেকটা কিশোর-রফি’র লিরিক বইয়ের মতো), যেখানে ভাদু গানের কথা লিখে ছাপাচ্ছেন কিছু পুরুষও, অবশ্যই নারীর স্বরে। ঠিক যেমন বিচ্ছেদী গানে রাধা’র ব্যথার কথা লেখেন পুরুষ’রা। এই সব গানে যেমন ঝুমুর গানের প্রভাব খুব থাকে, তেমনই দেখা যায় যে রামপ্রসাদী সুরেরও অসম্ভব ঝোঁক। বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কিন্তু এটা, কারণ রামপ্রসাদী গানের ধুয়ো ধরে লোক সঙ্গীতে বিশেষ চর্চা হয় না।


পৌরাণিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়কেই ভাদু গানে তুলে ধরা হয়। মূলত পাঁচালির সুরেই চার লাইনের ভাদুগান গাওয়া হয়। সারারাত জেগে গান গাওয়ার পর শেষ রাতে সকলে মিলে ভাদুকে বিসর্জন দিতে যান। সেই সঙ্গে করুণ সুরে সকলে গেয়ে ওঠেন...


'ভাদু যায়ো না জলে
কোলের ভাদু যায়ো না মোদের ছেড়ে
গটা ভাদর থাকলে ভাদু গো
মা বলে ত ডাকলে না
যাবার সময় রগড় লিলে
মা বিনে ত যাব না'।


ভাদু গানের আসর  আমার গীতিকবিতা (অষ্টম পর্ব)
কথা - আঞ্চলিক সুর - অপ্রচলিত
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


ভাদু লিয়ে ল্যা,
লিয়ে ল্যা , পয়সা বারো আনা।
কিইন্যা খাবি, কিইন্যা খাবি.....
বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা।।


ভাদর মাসে ভাদু পূজা করবো সবাই ভাদুগান।
আমার ভাদু দক্তা খায় না খেতে দিব খিলিপান।।


চল চল ভাদু মা মেলায় কিনে দিব রেশমীচুড়ি।
আসার পথে খেয়ে আসবো লংকা ঘুগনি মুড়ি।।


ভাদু লিয়ে ল্যা,
লিয়ে ল্যা , পয়সা বারো আনা।
কিইন্যা খাবি, কিইন্যা খাবি.....
বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা।।


আমার ভাদু খায়না খাড়ি আলু কচুর তরকারি।
ত্রিশ টাকা কিলো আলু আস্যে কত পাইকারি।।


চল ভাদু চল জলকে যাব অজয় লদীর উধারে।
আসার পথে দেখবো কত কাশফুল ধারে ধারে।।


ভাদু লিয়ে ল্যা,
লিয়ে ল্যা , পয়সা বারো আনা।
কিইন্যা খাবি, কিইন্যা খাবি.....
বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা।।


ও ভাদুমা ও ভাদুমা তোমার কেন মন খারাপ।
আঁচিলে পাঁচিলে ঘুরে বর্ষাকালে হলহল্যা সাপ॥


আষাঢ় গ্যালো শাওন গ্যালো এল্য ভাদর মাস।
চল ভাদু চল মাঠকে যাব কাটব্য আলে ঘাস॥


ভাদু লিয়ে ল্যা,
লিয়ে ল্যা পয়সা বারো আনা।
কিইন্যা খাবি, কিইন্যা খাবি
বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা।।