যা দেবী সর্বভূতেষু… মহিষাসুরমর্দিনী
মহালয়া স্তোত্রম্ – প্রথম পর্ব।  
সংগ্রহ, সম্পাদনা ও স্তোত্রপাঠ- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।


“ সর্বভূতা যদা দেবী স্বর্গমুক্তি প্রদায়িনী।
ত্বং স্তুতি স্তুতয়ে কা বা ভবন্তি পরমোক্তয়।।


সর্বস্য বুদ্ধিরূপেণ জনস্য হৃদি সংস্থিতে।
স্বর্গাপবরগদে দেবী নারায়ণী নমোহস্তুতে।।“


হিন্দু ধর্মবিশ্বাস মতে, অশুভ শক্তির বিনাশ আর ধর্ম রক্ষায় যুগে যুগে মর্ত্যলোকে দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছে। যার ধারাবাহিকতাতেই অসুর কূলের হাত থেকে দেবগণকে রক্ষায় দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছিল। পৃথিবীতে যখনই ব্রহ্মার বরপ্রাপ্তের মতো শক্তিশালী মহিষাসুরেরা ফিরে আসে বারবার, ধর্মের গ্লানি হয় এবং পাপ বৃদ্ধি পায়, তখন তাদের ত্রাস-সংহারে দেবী দুর্গা ফিরে আসেন বারবার। আর দেবীর এ শুভাগমন ঘটে শুভ মহালয়ায়। মহালয়ার শুভক্ষণে যাবতীয় আঁধার গ্লানি মুছে যায় অসুরনাশিনী দুর্গার তেজচ্ছটায়।


কালিকা পুরাণ মতে– দুন্দুভি নামক জনৈক দৈত্যরাজ, ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে– দেবতাদের পরাজিত করেছিলেন। কৈলাসে মহাদেব ও পার্বতীকে একত্রে ভ্রমণ করার সময় পার্বতীকে দেখে মোহিত হন, এবং তাঁকে অধিকার করার চেষ্টা করলে- মহাদেবের অগ্নিদৃষ্টিতে ইনি ভস্মীভূত করেন। [চতুর্থোহধ্যায়, কালিকাপুরাণ]


শুম্ভ-নিশুম্ভ হত্যা এবং এই উপলক্ষে দুর্গার বিভিন্ন নামপ্রাপ্তি


দুর্গা কর্তৃক ধুম্রলোচন বধ ও  মাতঙ্গী এবং একজটা নামপ্রাপ্তি
শুম্ভ-নিশুম্ভ নামে দুই অসুরের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে– দেবতারা মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে এসে- দুর্গার আরাধনা করেন। আরাধনায় তুষ্ট হয়ে এই দেবী প্রথমে মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর রূপ ধরে দেবতাদের কাছে আসেন এবং পরে একটি বিশেষ মূর্তি ধারণ করেন। এই মূর্তিতে এঁর চার হাত ও গলায় নরমুণ্ডমালা ছিল। এই মূর্তি মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর রূপ মাতঙ্গী’র দেহরূপ থেকে নির্গত হয়েছিল বলে– এর নাম হয়েছিল মাতঙ্গী। এই মূর্তীতে দুর্গার মাথায় একটি মাত্র জটা থাকায় ইনি একজটা নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।


মার্কেণ্ডেয় পুরাণের মতে, হিমালয়ে গিয়ে দেবতারা দেবীর স্তব করেছিলেন। এই সময় পার্বতী জাহ্নবী নদীতে স্নান করতে অগ্রসর হলে, দেবতাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার স্তব করছো। এই বাক্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে, পার্বতীর শরীরকোষ থেকে দুর্গা দেবী প্রকাশিত হলেন। এই কারণে, দেবীর অপর নাম কৌষিকী। এরপর পার্বতী কৃষ্ণকায় মূর্তি ধারণ করলেন। এই রূপের জন্য তিনি কালিকা নামে অভিহিত হলেন।    


দুর্গার কৌষিকী এবং কালিকা নামপ্রাপ্তি
পরে ইনি মনোহর মূর্তি ধারণ করলে– শুম্ভ-নিশুম্ভের সেনাপতিরা এই নারীরূপ সম্পর্কে শুম্ভ-নিশুম্ভকে জানান। এরপর শুম্ভ-নিশুম্ভ দেবীর কাছে সুগ্রীব নামক এক দূতের দ্বারা বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। দেবী এই দূতকে জানান যে, যে তাঁকে যুদ্ধে হারাতে পারবেন, তাঁকেই তিনি বিবাহ করবেন। এই কথা শুনে শুম্ভ-নিশুম্ভ ধূম্রলোচনকে সেনাপতি করে একদল সৈন্য পাঠান এবং ধূম্রলোচনকে এই নির্দেশ দেন যেন সে দেবীর চুল ধরে নিয়ে আসেন। ধূম্রলোচন দেবীর সম্মুখে এলে, দেবী তাঁকে ভস্মীভূত করেন।


দুর্গা কর্তৃক চণ্ড-মুণ্ড বধ ও দিগম্বরী, আকর্ণনয়না, পূর্ণযৌবনা, মুক্তকেশী, লোলজিহ্বা, মুণ্ডুমালাবিভুষিতা, চতুর্ভুজা, শ্যামবর্ণ, কালী এবং চামুণ্ডা  নামপ্রাপ্তি এরপর শুম্ভ-নিশুম্ভ  দেবীকে ধরে আনার জন্য চণ্ড-মুণ্ডকে পাঠান। হিমালয়ের শিখরে তাঁরা দেবীকে আক্রমণ করলে– দেবীর ললাট থেকে অপর একটি ভয়ঙ্কর দেবী নিষ্ক্রান্ত হন। এই দেবী কালী নামে অভিহিত হয়ে থাকেন। এই সময় ইনি কালীরূপ-সহ দশটি রূপ ধরে যুদ্ধ করেছিলেন। এই দশটিরূপকে দশটি নামে অভিহিত করা হয়।  এই নামগুলো হলো– দিগম্বরী, আকর্ণনয়না,পূর্ণযৌবনা, মুক্তকেশী, লোলজিহবা, মুণ্ডমালাবিভুষিতা, চতুর্ভুজা, শ্যাম বর্ণ ও কালী।


মূলত কালীর ছিল চারটি হাত। এর মধ্যে দুই ডান হাতে ছিলে খট্বাঙ্গ ও চন্দ্রহাস, বাম দুই হাতে রয়েছে  চর্ম ও পাশ। এঁর গলায় ছিলে নরমুণ্ডু ও দেহ বাঘের ছালে আবৃত। এঁর দাঁত দীর্ঘ, রক্তচক্ষু, বিস্তৃত মুখ ও স্থূল কর্ণ। যুদ্ধ ক্ষেত্রে আবির্ভুতা হয়েই দেবী অসুর সৈন্য ও হাতি ঘোড়া মুখে পুড়ে আহার করা শুরু করেন। ফলে অসুর সৈন্যরা ভীত হয়ে পড়লেন। এরপর চণ্ড-মুণ্ড দেবীর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অস্ত্র নিক্ষেপ করলে, দেবী তা মুখে গ্রহণ করে অট্টহাস্য করতে লাগলেন। এরপর ইনি চণ্ড ও মুণ্ডকে হত্যা করলেন। এই দেবী চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করে দুর্গার মূল মূর্তির কাছে গেলে, দুর্গা তাঁকে চামুণ্ডা (চণ্ড-মুণ্ডকে হত্যা করার কারণে) নামে অভিহিত করেন। উল্লেখ্য অম্ (সূক্ষ্ম) রূপযুক্তা– এই অর্থে কালীর অপর নাম অংশস্বরূপা।


যুদ্ধে দেবতাদের সহায়তা
চণ্ড-মুণ্ডের নিহত হওয়ার কথা শুনে, শুম্ভ নিজেই বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে অগ্রসর হন। এই সময় অন্যান্য দেবতারা দেবীকে শক্তি ও অস্ত্র দ্বারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। এই সময় যে সকল দেবতারা সাহায্য করার জন্য এসেছিলেন, তাঁরা হলেন– ব্রহ্মার তাঁর ক্ষমতা নিয়ে হংসবাহনে এবং ব্রহ্মাণী অক্ষসূত্র ও কমণ্ডলু ধারণ করে আসেন । ষাড়ের পিঠে চড়ে মহাদেব সর্পবলয় ও চন্দ্ররেখা ভূষণ ধারণ করে ত্রিশূল হাতে নিয়ে আসেন। গুহরূপিণী কৌমারী ময়ুর বাহনে শক্তিশেল নিয়ে আসেন। বৈষ্ণবী শক্তি নিয়ে গরুড়ের পিঠে চড়ে আসেন বিষ্ণু। এঁর হাতে ছিল শঙ্খ, চক্র, গদা ও খড়্গ। এছাড়া বিষ্ণুর যজ্ঞবরাহ মূর্তি, নৃসিংহমূর্তিও যোগ দিয়েছিলেন এর সাথে। ইন্দ্র এসেছিলেন বজ্র হাতে ঐরাবতে চড়ে।


চণ্ডিকা মুর্তির আবির্ভাব  
দেবী চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলে, তাঁর শরীর থেকে চণ্ডিকা শক্তি নিষ্ক্রান্ত হলো। এরপর দেবী কিছু শর্ত দিয়ে মহাদেবকে চণ্ড-মুণ্ডের কাছে দূত হিসাবে পাঠান। কিন্তু মহাদেবের এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে, দেবীকে আক্রমণ করলো। ফলে দেবীর চণ্ডিকা ও কালী মূর্তিসহ-  সকল দৈবশক্তি অসুরদের হত্যা করতে লাগলেন।


রক্তবীজ বধ
ভীত অসুর সৈন্যদের উৎসাহ দিয়ে রক্তবীজ নামক অসুর যুদ্ধক্ষেত্রে এলো। এই অসুরের রক্ত মাটিতে পড়লে, তা থেকে অসংখ্য অসুর সৈন্য জন্মগ্রহণ করতো বলে, এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল। রক্তবীজ ইন্দ্রের-শক্তির সাথে যুদ্ধ শুরু করলে, এই শক্তি বজ্র দ্বারা তাকে আঘাত করলেন। এর ফলে আহত রক্তবীজের শরীর থেকে নির্গত রক্ত বিন্দু থেকে অসংখ্য অসুর সৈন্য সৃষ্টি হতে থাকলো। অন্যান্য দৈব শক্তির আঘাতের ফলে একই ঘটনা ঘটতে থাকলে, অচিরেই যুদ্ধক্ষেত্র অসুর সৈন্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। এরপর চণ্ডিকা কালীকে ডেকে বললেন যে, রক্তবীজকে আঘাত করলে, যে রক্তপাত হবে, তা কালী খেয়ে ফেললে, সৈন্য উৎপাদন বন্ধ হবে। এরপর চণ্ডিকা রক্তবীজকে আঘাত করলে, কালী তার রক্ত খেয়ে ফেলতে লাগলেন। একসময় রক্তবীজ রক্তশূন্য হয়ে ভূমিতে পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।


শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ  
রক্তবীজের হত্যার পর শুম্ভ-নিশুম্ভ নিজেরাই সসৈন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে আসে। এই যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে দেবীর শরাঘাতে নিশুম্ভ ভূপাতিত হলে, শুম্ভ তাঁকে আক্রমণ করে। কিন্তু কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর শুম্ভ শূলের আঘাতে মূর্চ্ছিত হয়। পরে নিশুম্ভ চেতনা লাভ করে দেবীকে পুনরায় আক্রমণ করে।  দেবী প্রথমে নিশুম্ভের বুকে শূলের আঘাত করলে, তার হৃদয় থেকে একটি পুরুষ মূর্তি নির্গত হয়। এরপর দেবী খড়গের আঘাতে এই পুরুষের শিরশ্ছেদ করেন। ফলে নিশুম্ভের মৃত্যু হয়। এরপর শুম্ভ চেতনা লাভ করে দেবীকে বলে যে, এই সব সহকারী শক্তির বলে যুদ্ধ করছে, মূলত দেবীর কোন শক্তি নেই। শুম্ভের এই কথা শুনে দেবী সকল সহকারী শক্তি তাঁর দেহের ভিতর টেনে নিয়ে এককভাবে শুম্ভের মুখোমুখী হন। এরপর শুম্ভ তাঁকে আক্রমণ করলে, দেবী সকল আক্রমণ প্রতিহত করলেন। এই সময় শুম্ভ দেবীকে আকাশে তুলে নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। একসময় দেবী শুম্ভকে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করে মাটিতে নেমে এলে,  শুম্ভ মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে দেবীকে আক্রমণ করে। কিন্তু দেবী শূলের আঘাতে শুম্ভকে হত্যা করেন।


আসুন আমরা জেনে নিই মহালয়ার তাৎপর্য, যেখানে আছে দেবী দুর্গার অসুররাজ মহিষাসুরকে পরাস্ত করার কাহিনী।


মহালয়া : কেন মা দুর্গাকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বলা হয়?


মহিষাসুর কে ছিলেন? ‘মহিষাসুর’ একটি সংস্কৃত শব্দ যা ‘মহিষা’ শব্দ থেকে উৎপত্তি, এর অর্থ ‘মহিষ’ এবং ‘অসুর’ শব্দের অর্থ রাক্ষস বা দৈত্য। বিভিন্ন প্রাচীন হিন্দু কাহিনীতে মহিষাসুরকে অপদেবতা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মহিষাসুর ছিলেন অসুরাজ রম্ভ-র সন্তান। অসুররাজ রম্ভ ছিলেন এক ভয়ঙ্কর দৈত্য, যিনি ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত ছিলেন। অসুর ও দেবতাদের মধ্যে তিনি অজেয় ছিলেন। মা দুর্গাকে কেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বলা হয়?


মহিষাসুর ভগবান ব্রহ্মের একনিষ্ঠ উপাসক ছিলেন। বহু বছর তপস্যার পর ব্রহ্মা তাঁকে একটি বর প্রদান করেছিলেন। মহিষাসুর নিজের শক্তি নিয়ে গর্বিত ছিলেন। তিনি ভগবান ব্রহ্মার কাছ থেকে অমরত্বের বর চেয়েছিলেন, এবং তাঁর ইচ্ছা ছিল পৃথিবীর কোনও মানুষ বা প্রাণী তাঁকে যেন হত্যা করতে না পারে। ব্রহ্মা তাঁকে এই বর প্রদান করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তিনি একজন মহিলার কাছে পরাস্ত এবং নিহত হবেন।


মহিষাসুর তাঁর শক্তির ওপর এতটাই আস্থা করতেন যে তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, এই পৃথিবীতে কোনও মহিলাই তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। মহিষাসুর তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে ত্রিলোক (স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল) আক্রমণ করেন এবং ইন্দ্রলোকও (ভগবান ইন্দ্রের রাজ্য) জয় করার চেষ্টা করেন। তাঁর অত্যাচারে সারা জগৎ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।


দেবতারা মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধ করলেও ভগবান ব্রহ্মার আশির্বাদের ফলে কেউ তাঁকে পরাস্ত করতে পারেনি। এরপর, দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর কাছে সাহায্য প্রার্থী হন। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য সমস্ত দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব তাঁদের সমস্ত শক্তি একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করেন দেবী দুর্গার।


মহিষাসুর নামক অসুর স্বর্গ থেকে দেবতাদের বিতারিত করে স্বর্গ অধিকার করলে, দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা এর প্রতিকারের জন্য মহাদেব ও অন্যান্য দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হন। মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য ছিলেন বলে– বিষ্ণু দেবতাদের পরামর্শ দেন যে, –প্রত্যেক দেবতা নিজ নিজ তেজ ত্যাগ করে একটি নারীমূর্তি সৃষ্টি করবেন। এরপর সমবেত দেবতারা তেজ ত্যাগ করতে আরম্ভ করেন। যে যে দেবতার তেজ থেকে এই নারী মূর্তির শরীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি হলো, তা এ রূপ– মহাদেবের তেজে মুখ, যমের তেজে চুল, বিষ্ণুর তেজে বাহু, চন্দ্রের তেজে স্তন, ইন্দ্রের তেজে কটিদেশ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরু,পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের আঙ্গুল, বসুদের তেজে হাতের আঙ্গুল, কুবেরের তেজে নাসিকা, প্রজাপতির তেজে দাঁত, অগ্নির তেজে ত্রিনয়ন,সন্ধ্যার তেজে ভ্রূ, বায়ুর তেজে কান এবং অন্যান্য দেবতাদের তেজে শিবারূপী দুর্গার সৃষ্টি হলো।


এরপর দেবতারা তাঁকে বস্ত্র, পোশাক ও অস্ত্র দান করলেন। এক্ষেত্রে যাঁরা যা দান করলেন, তা হলো– মহাদেব দিলেন শূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনু ও বাণপূর্ণ তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, ঐরাবত দিলেন ঘণ্টা, যম দিলেন কালদণ্ড, বরুণ দিলেন পাশ, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলূ, সূর্য দিলেন রশ্মি, কালখড়্গ ও নির্মল চর্ম, ক্ষিরোদ সাগর দিলেন অক্ষয়বস্ত্রসহ বিভিন্ন অলঙ্কার ও আভরণ, বিশ্বকর্মা দিলেন পরশুসহ নানাবিধ অস্ত্র, অভেদ্য কবচমালা, হিমালয় দিলেন সিংহ, কুবের দিলেন অমৃতের পান পাত্র, শেষ নাগ দিলেন নাগহার ও অন্যান্য দেবতারা তাঁদের সাধ্যমতো বিষয় উপহার দিলেন। এরপর দেবতারা সমবেতভাবে তাঁকে সম্মান দেখানোর সাথে সাথে দেবী অট্টহাস্য করতে লাগলেন। তাঁর হাসিতে পৃথিবী কম্পিত হতে লাগলো। অসুররা এই কম্পনের কারণ জানতে এসে দেবীকে দেখলো। এরপর দেবীর সাথে অসুরের যুদ্ধ আরম্ভ হলো। এই যুদ্ধে মহিষাসুরের পক্ষে যে যে সেনাপতি বিশাল বাহিনী নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা হলো–


চামর ও চিক্ষুর : চতুরঙ্গ সৈন্য
মহাহনু : অযুত হাজার রথ ও সৈন্য
অসিলোমা : পঞ্চাশ নিযুত রথ ও সৈন্য
বাস্কল : ষাট লক্ষ সৈন্য, সহস্র হাতি ও এক কোটি রথ।
বিড়ালাক্ষ : অযুত সৈন্য ও পঞ্চাশ অযুত রথ


অন্যান্য ছোট খাট সেনাপতিরা তাঁদের সাধ্যমতো সেনাদল নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিল। এই সময় মহিষাসুর নিজে কয়েক কোটি রথ হাতি, অশ্ব ও সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।


অসুরদল দুর্গাকে আক্রমণ করলে, ইনি তা অবলীলায় প্রতিহত করলেন। তারপর ইনি শ্বাস ত্যাগ করলে, শতসহস্র প্রমথ সৈন্য সৃষ্টি হলো। এই সৈন্যরা পরশু, পট্টিশ, অসি ও ভিন্দিপালের আঘাতে অসুরদের হত্যা করতে লাগলো। দেবী ত্রিশূল, গদা, শক্তি, ঋষ্টি, খড়গ ব্যবহার করে অসুরদের বিনাস করতে লাগলেন। ক্রমে সকল সৈন্য ও সেনাপতিরা নিহত হলে, মহিষাসুর  নিজে মহিষের রূপ ধরে সারা পৃথিবী ক্ষুব্ধ করে দেবীর মুখোমুখী হলো, দেবী তাকে পাশ দিয়ে বেঁধে ফেললেন। এই অবস্থায় মহিষাসুর তার মহিষরূপ ত্যাগ করে,সিংহের রূপ ধারণ করলো। এই সময় দেবী তার শিরশ্ছেদ করলেন। সাথে সাথে অসুর খড়গধারী পুরুষ মূর্তিতে উপস্থিত হলো। এবার দেবী এই মূর্তিকে তার খড়গসহ কেটে ফেললে, অসুর হাতির রূপ ধরলো। তারপর শুড় দিয়ে দেবীর বাহন সিংহকে টানার চেষ্টা করলে,দেবী এঁর শুড় কেটে দিলেন। এবার অসুর পুনরায় মহিষের রূপ ধরে পুনরায় ত্রিলোক তছনছ করে বেড়াতে লাগলো। এই সময় দেবী অমৃত পান করে ক্রোধে হাসতে লাগলেন। অসুর শিঙ দিয়ে পর্বত উত্তোলন করে দেবীর প্রতি নিক্ষেপ করলে, দেবী শর নিক্ষেপ করে তা চূর্ণ করে ফেললো। এরপর দেবী মধুপান করে মহিষাসুরের উপর লাফিয়ে উঠে পায়ের নিচে চেপে ধরলেন। তারপর গলার উপর পা রেখে শূল দ্বারা আঘাত করলেন। এরপর মহিষের মুখ থেকে অসুরের নিজ মূর্তির অধ্বাংশ বের হওয়ার সাথে সাথে, দেবী তাকে বেঁধে ফেললেন। এই অবস্থায় অসুর যুদ্ধ করতে থাকলে, দেবী খড়গ দিয়ে তার শিরশ্ছেদ করলেন। এরপর দেবতা ও ঋষিরা দেবীর বন্দনা করলেন। দেবতারা বললেন, তাঁরা এরূপ বিপদে পড়লে, দেবী যেন পুনরায় তাঁদের উদ্ধার করেন। দেবী সেই বর দিয়ে অন্তর্হিত হলেন।   কথিত আছে, দুর্গা মহিষাসুরকে তিনবার হত্যা করেন। প্রথমবার ইনি অষ্টাভূজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার ভদ্রাকালী ও দশভূজা দুর্গারূপে। মহিষাসুরের অনুরোধে মহিষাসুর দুর্গার উক্ত তিন ধরনের মূর্তির সাথে পূজিত হয়ে থাকেন।


প্রায় ১৫ দিন ধরে মহিষাসুরের সাথে দেবী দুর্গার লড়াই চলে। মহিষাসুর একের পর এক আলাদা আলাদা রুপ ধারণ করতে থাকে। অবশেষে, যখন মহিষের রূপান্তরিত হলেন, তখন দেবী দুর্গা ত্রিশুল দিয়ে তাঁর বুকের উপরে আঘাত করে হত্যা করেছিলেন। মহিষাসুরমর্দিনী অর্থাৎ মহিষাসুরকে দমনকারী।


মহিষাসুর মহালয়ার দিন দেবী দুর্গার হাতে পরাস্ত ও নিহত হন। সেই থেকে দেবী দুর্গার নাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
শরতের আগমনী-পূজোর কবিতা সংকলন
সমাপ্তি পর্ব- পূজোর আগমনী কবিতা
কবি-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


দুর্গাপুজোর আর মাত্র কয়েকটা দিন। পুজোর কেনাকাটা, প্ল্যানিং বহু ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে সবার। প্রতি বছর মহান উদ্যোগ এবং উদ্দীপনা সাথে উদযাপিত হয় দুর্গোৎসব। পুজোর কিছুদিন বাকি থাকলেও, দেবীপক্ষের সূচনার দিন অর্থাৎ ‘মহালয়া’ প্রত্যেকের দরজায় কড়া নাড়ছে। এইবছর, মহালয়া পড়েছে ২৮ সেপ্টেম্বর। অতএব, ইতিমধ্যেই উৎসবের প্রস্তুতি জোরকদমে চলছে।


কোন বাহনে চড়ে দেবীর আগমন ও গমন হবে এবার? কীভাবে নির্ধারিত হয় দেবীর আসা যাওয়া?
প্রতি বছরই বাঙালি বিজয়ার পর থেকে পরের বছরের পুজোর (puja) জন্য অপেক্ষা করে। ‘আসছে বছর আবার হবে!’ এই কথা যেন সার্থক। আর মহালয়া হয়ে গেলে তো আর কাজ কর্মে একদমই মন বসে না। তবে আমরা যেমন রূপচর্চা থেকে শরীরচর্চা থেকে শপিং এসব নিয়ে মেতে থাকি, বাড়ির বড়রা গম্ভীর মুখে বসে পড়েন পাঁজি বা পঞ্জিকা নিয়ে। তাঁদের চিন্তার বিষয় হল, এবার দেবী কিসে আসছেন (coming) আর কিসে যাবেন (going)। অর্থাৎ দেবীর আগমন ও গমন কিসে । কিন্তু এটা নিয়ে এত ভাবনা চিন্তার কী আছে। চিন্তার বিষয় একটাই। দেবী কিসে আসছেন আর কিসে যাচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। দেবী যাওয়ার পর ফসল কেমন হবে, দেশে কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটবে কিনা, এসব নাকি নির্ভর করে এই আসা যাওয়ার উপর! তা এবারে কিসে  করে আসছেন মা দুর্গা (durga)? যাচ্ছেনই বা কিসে?


এবার পুজো শুরু হচ্ছে ৩ অক্টোবর থেকে। সেদিন হল পঞ্চমী। পঞ্জিকা বলছে এবার মা আসছেন ঘোটকে বা ঘোড়ায় চেপে। দশমীর দিন তিনি ফিরেও যাচ্ছেন ঘোড়ায় চেপে। অর্থাৎ এই বছরে দেবীর আগমন ও গমন ঘোটকে। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতরা বলছেন, ঘোড়ায় আগমন ও গমন মোটেই শুভ নয়। ঘোড়া ছটফটে প্রাণী। সে যখন যায়, সব কিছু ছত্রভঙ্গ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই দেবীর ঘোটকে আগমন ও গমনে প্রমাদ গুনছেন শাস্ত্রজ্ঞরা। এতে ফসল নষ্ট হওয়ার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা ও খরা হতে পারে। দেখা দিতে পারে মহামারী ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। জানেন কি কীভাবে দেবীর বাহন প্রতি বছর বেছে নেওয়া হয়। অর্থাৎ তিনি কিসে চড়ে আসবেন ও যাবেন, সেটা জানার জন্য একটা মজার অঙ্ক আছে!


শাস্ত্র বলে


দেবীর মর্তে আগমন হয় সপ্তমীতে আর গমন হয় দশমীতে। এই দুটো দিন কোন বার পড়েছে সেই অনুযায়ী ঠিক হয় দেবী কীসে আসবেন আর কিসে যাবেন। উপরের এই শ্লোক দেখে বোঝা যাচ্ছে, সপ্তমী ও দশমী রবিবারে পড়লে দেবী গজ বা হাতিতে আসবেন ও যাবেন। যদি সপ্তমী শনিবার বা মঙ্গলবার হয় তা হলে ঘোটক বা ঘোড়ায় আসবেন। যেমনটা এই বারে হয়েছে। বৃহস্পতি বা শুক্রবার সপ্তমী হলে দেবী দোলায় আসবেন। আর বুধবার সপ্তমী বা দশমী পড়লে, তিনি নৌকায় আসবেন। দেবী কিসে করে এলে ঠিক কী হতে পারে, তার বর্ণনাও শাস্ত্রে আছে। যেমন বলা হচ্ছে, “গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণ বসুন্ধরা।” অর্থাৎ গজে এলে বা গমন হলে বসুন্ধরা শস্য শ্যামলা হয় অর্থাৎ ফসল ভাল হয়। আবার “ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে” এটি বলা হয় ঘোটকের ক্ষেত্রে। নৌকার ক্ষেত্রে বলা হয় “শস্যবৃদ্ধিস্থুতাজলম”। অর্থাৎ নৌকায় এলে শস্য দ্বিগুণ হয় কিন্তু বন্যা দেখা দিতে পারে। দোলায় বা আগমন বা গমনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, “দোলায়াং মরকং ভবেত।” অর্থাৎ দোলায় এলে বা গমন হলে মহামারী, ভুমিকম্প বা বড় রকমের যুদ্ধ হতে পারে।


বর্ষার দীর্ঘ বর্ষণ শেষে যখন সাদা তুলোর পেঁজার মতো মেঘদল আকাশে ভেসে বেড়ায়, রাতে ঝরে মৃদু শিশির, তখন শরতের প্রাক্কালে অরুণ রাঙা দৃপ্ত চরণে সূচনা হয় দেবীপক্ষের। শাঁখ কাঁসার শব্দে, উলুধ্বনিতে, চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে মর্ত্যালোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। শ্রী শ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার ধরাধামে আগমনই শুভ মহালয়া হিসেবে পরিচিত। অসুরনাশিনী দেবী দুর্গা প্রতি বছর মর্ত্যে আসেন তার ভক্তকূলের জন্য শক্তির বর নিয়ে। মহালয়ার সময়, ইতিহাস, পালনপ্রথা ইত্যাদি নিয়েই আমাদের আজকের এ আয়োজন।  আমার পরবর্তী কাব্য “ যা দেবী সর্বভূতেষু…… মহিষাসুরমর্দিনী” আগামীকাল রাত্রি ১২ টায় দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে। সকলের সহযোগিতা কাম্য।
সাথে থাকবেন- এটা প্রত্যাশা করি। }
জয়গুরু!


শরতের আগমনী-পূজোর কবিতা সংকলন
সমাপ্তি পর্ব- পূর্ব প্রকাশিত পূজোর আগমনী কবিতা
কবি-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী


শরৎ এসেছে, পরাগ মেখেছে
শিউলি ফুটেছে বনে,
বেলি ও টগর শোভে মনোহর
শরতের আগমনে।


শারদ আকাশে পূবে রবি হাসে
সোনা রোদ আঙিনায়,
পূজা এলো কাছে মন্দির মাঝে
ঢাকীরা ঢাক বাজায়।


শারদ আকাশে সাদা মেঘ ভাসে
অজয়ের দুই কূলে,
অজয়ের চরে শালিকেরা উড়ে
শোভা দেয় কাশফুলে।


সবুজের খেতে প্রাণ উঠে মেতে
সুশীতল হাওয়া বয়,
সোনা রোদদুরে অজয়ের চরে
স্মৃতি হয়ে কথা কয়।


যেদিকে তাকাই দেখিবারে পাই
শরতের সোনা ছবি,
পূর্বদিকে দেখি লাল রং মাখি
ওঠে শরতের রবি।