কবি স্বপন বিশ্বাসের ‘আজ অবসর’  দুবার পড়ে একটা মন্তব্য লিখেই চলে এলাম। কিন্তু ‘নেই কাজ তো খই ভাজ।’এ বাংলা প্রবাদটি ক্রিং ক্রিং করে নক করে যাচ্ছে অন্তর টেলিফোনে।কিন্তু মনে হলো এ কবিতায় একটা জীবনাবিজ্ঞতা এবং কথার পিছনের কথায় ‘সিনিয়র সিটিজেনদের’ একটা যাতনা গাথা ধরা পরেছে। আসলেই কি তাই? চলুন তাহলে তাঁর কবিতার অভ্যন্তরে প্রবেশে সচেষ্ট হই।


“ এতটাই পথ আজ পেরোলাম।/ ছোট নদী, বড় দিন/মরীচিকা মহুয়ার বন/ কাঁটাঝোপ/ সারা গায়ে অজস্র আঁচড় নিয়ে/ তপ্ত উঠোন,/ ছেড় ছেড়ে চেনামুখ/ পেরিয়ে পেরিয়ে কত নাম/ ছেঁড়া চটি, ঘেমো শার্ট/ ছেঁড়া কিছু বুকের বোতাম/ কত ঝড় বৃষ্টির পর/ জেগে ওঠা চর/ ছাওনির ঘর;/ এই বসলাম/ দুপুরের পর/ কতদিন… পর। নেই কাজও কাজ এক, ক্রমে জানব/ জানাব অতঃপর।”


জীবন একটা ভ্রমণ, একটা দৌড়। প্রত্যুষ থেকে সন্ধ্যা সূর্য বেগে চলা। এই চলার পথে মানুষকে কতো প্রতিকূলতা, কতো মায়া,কতো কষ্ট, কতো স্মৃতি,কতো বিস্মৃতি, কতো না পাওয়া সহ্য করতে হয়। অতঃপর খানিকটা পাওয়া নিয়ে একটু তৃপ্তিতে জিরোতে বসা। তারপর কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটে কতো দশা।সবশেষে তুমুল প্রতিক্ষা- ‘মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান’।


কবির এ কবিতায় অনেকটা এমনি ভাব প্রস্ফুট। একটা মধ্যবৃত্ত জীবনের রোজনামচা। একটা মানুষ তাঁর কর্মকাল শেষ করে আপাত অবসরে এসে হাঁপ ছেড়ে পিছন পানে চেয়ে স্বগতঃ বলে ওঠে “এতটাই পথ আজ পেরোলাম”। কবির বর্ণনায় পাঠকমাত্রই একটা সাদামাটা জীবনের স্বপ্ন-বাস্তবতা, পাওয়া না পাওয়ার চিত্রটি পড়ে ফলেতে পারবেন। এখানেই কবির মুন্সিয়ানা।
এ কবি ছান্দসিক। এর ছন্দ বিশ্লেষণে গতিময়তার ঘাটতি ঘটে না। বরং জীবনের সফরের মতই চলমান।অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত দু ছন্দেই কবিতাটি মুক্তক হিসেবে পড়া যায়।মাত্রাবৃত্তে ‘অজস্র আঁচড় ৭’ ‘ ক্রমে জানব ৫/ জানাব অতঃপর ৭’। আবার অক্ষরবৃত্তে
‘তপ্ত উঠোন ৫’ ‘বৃষ্টির পর ৫’ ‘এই বসলাম ৫’ ‘ক্রমে জানব ৫’/ ‘জানাব অতঃপর ৭।’ এ রকম কয়েকটি জায়গায় ছন্দে বন্ধুরতা দেখা যায়। তাহলে উপায়, মিশ্রছন্দে ভাবলে ক্ষতি কি? অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত পর্বের মিশ্রণ। আমার তো ভালই লাগে। সে ক্ষত্রে কবি ইচ্ছে করলে শেষ চরণে/জানব ক্রমশঃ/ জানাব তারপর/। করতে পারেন।


এত চমতকার এক কবিতার পরিসমাপ্তি নিয়ে ব্যাক্তগত অতৃপ্তি থেকে গেল। একটু খোলাসা করি। কবিগণ তাঁর সময় থেকে অগ্রগামী থাকেন।  কিন্তু এখানে, নেই কাজও যে কাজ তা তিনি ক্রমে জানবেন তারপর জানাবেন। ঠিক আছে তিনি দেখেননি বলবেন কী করে? কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে কারা যাচ্ছে? সিনিয়র সিটিজেনদের পরিতক্ত স্হানে কারা রেখে আসছে?


সুতরাং কবি চাইলে সেই জ্বালাটা মিটাতে পারতেন। /নেই কাজও কাজ এক, জানলাম অতঃপর।/


মুক্তকেও চমকপ্রদ কিছু অনুপ্রাস কানে মধু ঢালে। পেরোলাম, নাম, বোতাম। ‘ন’ বর্ণের অনুপ্রাস.. দিন,বন, উঠান। পর,চর,ঘর, পর, অতঃপর।দারুণ। শুভেচ্ছা কবিবন্ধু।


নান্দনিক এ কবিতার জন্য আমিতো ফিদা! প্রিয় পাঠক আপনি?