জনজীবনের নিখাদ অভিজ্ঞতা থেকে দূর্বাদলের মতো গজিয়ে উঠে লোক-সাহিত্য। তাই সে চারু-কারুময়, আয়ূষ্মান। কৃত্রিমতা তার বড় অপছন্দ। শ্লীল- অশ্লীল বিষয়ে সে অতটা ছুতমার্গ বজায় রাখতে চায় না। যদি তা লোকছড়া আঙ্গিকের রচনা হয় তাহলে তো কথাই নাই।  তখন তার কন্ঠ হয়ে পড়ে বেশ সুরলা।যেমন-


১) মনে মনে মনকলা খাও!
২) মনে মনেই যখন খাইবি, পান্তা খাইবি ক্যান; বিরানি খা।
৩) মনে মনে বাতাসা খাইবা কেরে? রসগোল্লা খাও।
৪) কি করব জাতে/ জাত (পুঁটকি) মারছে ভাতে।
৫) মনে মনে বাদশার মেয়েকেও বিয়ে করা যায়।


এইসব লোককথাগুলো আমাদের সমাজে- গ্রাম-নগরে এখনো চলমান। অঞ্চলভেদে এর কথার ইষৎ পরিবর্তন থাকলেও মূলকথা প্রায় একই রকম হয়ে থাকে। শ.ম. শহীদের ‘গরীব’ ছড়া-কবিতাটি পড়তে পড়তে একথাগুলো মনে এল। তাঁর  কবিতাটি এমনই এক  যন্ত্রণাকাতর অনুভূতির বিভা ছড়ানো লোকজ কথনের সফল বিনির্মাণ।


আমাদের লোকজ ছড়ার আলাদা একটা সুর আছে। এ সুরটি তাঁর ‘গরীব’ শিরোনামের ছড়ায় দারুণভাবে বিদ্যমান। বাংলা ভাষায় কথোপকথন ঢঙের প্রচুর সফল ছড়া আছে।যেমন-
১) “দিদি লো দিদি, একটা কথা
কি কথা? ব্যাঙের মাথা….”। লোকজ।


২)“মনারে মনা কোথায় যাস?
বিলের ধারে কাটব ঘাস….”। আহসান হাবীব


৩)“ গাছি রে গাছি?
-এই যে আছি
কিসের কাছে?
-খেজুর গাছে….” রহমান মুজিব (নিজের ছড়ার একটি উদ্ধৃতি দেবার লোভ সামলতে পারলাম না)


এসব ছড়ার সহজাত সারল্য. গীতি,গতিময়তা প্রবল ভাবে মনকে নাড়া দিয়ে যায়। পড়ে দেখুন শ.ম. শহীদের ছড়া-কবিতাটি।


“-কিরে হাদা, করিস কী ভাই?
-লঙ্কা দিয়ে পান্তা ভাত খাই।
-পান্তা পেলি কোথায় বনে?
-খাচ্ছি গো ভাই মনে মনে-
ক্ষুধার জ্বালায় করবটা কি?
চক্ষু বুজেই গিলতে থাকি!


-মনে মনেই গিলবি যদি
খাসনা কেনো ননী-দধি?
-ওসব খাবার বেজায় দামি;
কি করে খাই? গরীব আমি!”


নিশ্চয়ই এ ছড়াটিও সহজাত সারল্য, সুর ,ছন্দ , গীতি ও গতিময়তায় এবং বেদনাবোধে আমাদের ভালো লাগার জায়গাটা পরিপূর্ণ করে দেয়। প্রশ্ন আসতে পারে লোকজ প্রবাদ-প্রবচনেই যদি এমন কথা থাকে, তাহলে এ নিয়ে আবার লিখার কি দরকার? আপনিই-বা আলোচনায় নামলেন কেন? বুঝেছি মশায় আপনাদের এই পুনরাবৃত্তির জন্যই প্লেটো তাঁর নগররাষ্ট্র থেকে কবিদের তাড়াতে চেয়েছিলেন!


জবাবে বলি, ধীরে বন্ধু। আসুন না দেখি, প্রচলিত কথার বাইরে গিয়ে  অর্থাৎ চর্বিত চর্বনের বাইরে গিয়ে এ ছড়া-কবিতায় বাড়তি কিছু বলা হলো কি-না।


“-ওসব খাবার বেজায় দামি;
কি করে খাই? গরীব আমি!”


এ দুটি লাইনই এ কিবতার হীরকখণ্ড বলে মনে হয়। এ কথাটি বলার জন্যই কবি কিছু বাওয়ালিকে বনে পাঠালেন। একজন ক্ষধার্ত তরুনের মূকাভিনয় দেখালেন এবং অপর বয়স্ক বাওয়ালিকে এনে দুজনের মাঝে কথা বলাবলি করালেন।  ভুখা মানুষ খাদ্য চাইবে এটাই স্বাভাবিক। সেই মানুষ নামের জীবটা যদি বাস্তবে তার চাহিদা পূরণ করতে না পারে, তাহলে ওটা সে অবচেতন মনে  ধারণ করে রেখে ‘মনে মনে মনকলা’ খেতেই পারে। ফ্রয়েডীয় দর্শন থেকেও আমরা এ কথার প্রমাণ পাই। আমরা এটাও জানি, মন রঙের ঘোড়া দৌড়াতে চায়। ‘ মনে মনে বাদশার মেয়েকেও বিয়ে করা যায়’। আবার তিনমাথা ওয়ালা পণ্ডিতেরা যখন বলে, ‘মারি তো গন্ডার; লুটি তো ভাণ্ডার’। কিংবা ‘মনে মনেই যখন খাইবি, পান্তা খাইবি ক্যান; বিরানি খা’। তখনও সেই চরম দরিদ্র লোকটি দারিদ্রের কশাঘাতে এমনই জর্জরিত, তার মনে গরিবীর সুনামি এমনই ধস নামিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত করে দিয়েছে যে, সে  কল্পনাতেও সাধ্যাতীত কিছু পাবার চিন্তা করতে পারে না! ক্রমাগত দারিদ্র তথা বঞ্চনা তার সাহস, স্বপ্ন নিঃশেষ করে মনোজগতে ধস নামিয়ে দিয়ে যায়। তার যাপিত জীবন হয় স্বপ্নহীন পঙ্গু।হারিয়ে ফেলে নিজের প্রতি আস্থা।
এই যে গূঢ় মনস্তাত্ত্বিক  জটিল বিষয়টি কবি সহজ কথায়, চাতুর্যের সাথে বলে দিলেন এ জন্যই কবিতাটি বারবার পঠনযোগ্য। একটা সহজ সরল ছড়া-কবিতায় যদি একটা মনোজাগতিক চিন্তন কারুময়তায় উঠে আসে, যদি বঞ্চনাকাতর জীবনের কথা মানবিক আবেদন নিয়ে উঠে আসে,আর ভেসে উঠে কতিপয় ছবি বা চিত্রকল্প, তাহলে তার তারিফ করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। স্বরবৃত্ত/ দলবৃত্ত ছন্দে ৪+৪=৮ মাত্রার সমপার্বিক দশ লাইনের ছড়া-কবিতাটির ছন্দ নিখুঁত। নামকরণ স্বার্থক।


চমৎকার এ সৃজনের জন্য আপনাকে অভিনন্দন কবি।


কবির প্রতি: দুজন বক্তার উক্তি প্রকাশ করতে যদি (-) একই চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তাহলে দেয়া না দেয়া সমান হয়ে যায় মনে হয়। হয় একজনের  উক্তির জন্য (-), অন্যজনের কথা  স্বাভাবিক চরণ রাখা যায়। অথবা কোন চিহ্ন না দিলেও হয়। অথবা লাইন বিন্যস্ত করেও উক্তির ভিন্নতা প্রকাশ করা যায়। গরীব > গরিব। ভেবে দেখতে পারেন।