একটা কবিতার প্রাণ সম্পদ তার ভাব। একজন কবি ভাবকে বাণীতে পরিণত করেন। ভাবের বাহন ভাষা। ভাষা যদি ভাবের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করে, যদি একটা মায়াজাল সৃষ্টি করতে পারে, তবে আমাদের মন তা গ্রহণে ব্যাকুল হয়। কথাগুলো ভাবছিলাম আসরের প্রিয়কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল এর ‘স্বপ্নের করব’ কবিতা পাঠান্তে।


“হৃদয় আকাশজুড়ে কী নিঃসীম অন্তর্জাল!
রয়েছে বিস্তৃত কতশত অনুভবের ফসল…”


কবি এভাবে তাঁর কবিতার মায়াজাল বিস্তার শুরু করেন। আসুন প্রথম চরণটি একটু বিশ্লেষণ করি। বুঝতে চেষ্টা করি একটা কবিতা কীভাবে কবিতা হয়ে ওঠে আর কবিতার ঐন্দ্রজালিক সক্ষমতা কিভাবে ক্রিয়াশীল হয়।


“ হৃদয় কাদা মাটির কোন মূর্তি নয় / আঘাত দিলেই ভেঙে যাবে…” একটা জনপ্রিয় বাংলা গীতি কবিতার অংশ। তাহলে হৃদয়টা কি? না, কোন দার্শনিক আলোচনায় যাবার দুঃসাহস দেখাচ্ছি না। তা করার সক্ষমতাও  নেই। তবে আপনাদের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি ‘হৃদয়’ মানুষ নামক হোমো সেপিয়েন্সদের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ যা ক্রিয়াশীল হয়ে মানুষকে কাঁদায়-হাসায়, আনন্দে ভাসায়। এটি না থাকলে কবিতা লিখার কল্পনাই করা যায় না। আলোচ্য কবিতার প্রথমেই আছে হৃদয়। শুধু কি হৃদয়! হৃদেয়ের আকাশ, যে আকাশে থাকে হালের হটকেক অন্তর্জাল! এ অন্তর্জাল কি যেই-সেই, একেবারে নিঃসীম! আকাশ অসীম, অন্তর্জাল অসীম। অসীমে অসীমে খেলা। অন্তর্জালকে ভাঙলে দেখি অন্তরের জাল বা অন্তরগ্রন্থি। গ্রন্থিতে থাকে জটিলতা। যে কবিতার একটিমাত্র চরণ এভাবে ভাবাতে সক্ষম, নিশ্চয় তা কবিতা হয়ে ওঠে। পাঠক মনেও এর জাদুকরি ক্ষমতা ক্রিয়াশীল হয়। উদ্ধৃত দুটি চরণের ছন্দ বিশ্লেষণ করলে অক্ষরবৃত্তে ৮, ৮/ ১০, ৮ মাত্রা পাওয়া যায়। যা কবির ছন্দ সচেতনতার পরিচায়ক।
কবি যাপিত জীবনের একটা বড় অংশ পার করে এবং অন্য অনেক জীবন পাঠকরে দেখেছেন মানুষের অন্তর্জালে  নানা অনুভব– সুখ-দুখ, হাসি-কান্না, আপন-পর, জ্বরা-ব্যাধি ইত্যকার বিচিত্র জগত তৈরি হয়। শৈশব কৈশোর যৌবন বিদ্যুৎ ঝলকের মতো চলে যায়। কিন্তু বার্ধক্য এলেই নানা আলেয়ার পিছু নেয় বিভাজিত মন। পিছু ফিরে দেখে সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান। আর আকাশের অগণিত তারাদের ভিড়ে খুঁজে অচেনা বন্দর। এমন কঠিন বাস্তবতায় এসে মন বদেনার্থ হয়। এ কথা যে চিরন্তন। আমার কথা, অপনার কথা,আমাদের কথা। আগত-অনাগত সবার কথা। কবির ভাষায়,


“তুলাদণ্ডে মাপা আপেক্ষিক সফলতা-ব্যর্থতার বহর;
প্রসারের ব্যপ্তি ,দৈর্ঘ-প্রস্থের গভীরতা।…
খৈ ছড়ানো তারাদের ভিড়ে খুঁজি অচেনা বন্দর”।


অতঃপর কবি সমস্ত জীবনাবিজ্ঞতার আলোকে উপসংহার টানেন হৃদয় চেরা আবেগী ভাষায়,


“ হায়, ঘুম ঘোরে ছিল মন, বুঝিনি কখন কে যে ...
নিভৃতে নীরবে ভেঙে দিয়ে খেলাঘর ….
রচে গেছে এক নালায়েক স্বপ্নের কবর”

এখানে এসে হৃদয়সূতোতে টান পড়ে। জীবনের ব্যালেন্সশিট মিলাতে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গের যাতনায় মন কাতর হয় । প্রাণে বাজে বিদায়ের বেহাগ। “আশায় আশায় দিন যে গল/ আশা পুরণ হলো না” (বাংলা গানের কথা) হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। টপ করে ঝরে পড়ে দুফোঁটা অশ্রু। আমাদের মধুরতম সংগীত তো তাই, যা বেদনার কথা বলে।


তাই পরিশেষে বলতে পারি, ‘স্বপ্নের কবর’ এক ঋদ্ধ কবির জীবন খুঁড়ে দেখা কবিতা। কবিকে একগুচ্ছ গোলাপ।


কবির প্রতি:  হায় এর পর (,) না হয়ে (!)   বিদ্যুদ্ঝলক > বিদ্যুৎ ঝলক হলে ভাল লাগবে।