একই মানবশরীরে মাস্টারমশাই ও ছাত্র নামক দুই মহামানবের সহাবস্থানের তত্ত্ব কবিতাটির মূল চালিকাশক্তি।
আলোচক-রণজিৎ মাইতি
কবি-শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য্য
-- -- -- -- -- -------


আমাদের ভেতর যেমন লুকিয়ে আছে 'সু' নামক মহান সুপুরুষটি,তেমনি হৃদয়ের গোপন গভীর কুঠরিতে ঘাপটি থাকে 'কু' নামক বদ মতলববাজ পুরুষটিও।কিন্তু 'কু' এবং 'সু' কখন কতোটা ক্রিয়াশীল হবে সেই ভারসাম্য নির্ভর করে আমাদের অর্জিত শিক্ষার ওপর।সুশিক্ষা একজন মানুষকে চালিত করে সুপথে। যদি সেই শিক্ষা থেকে মানুষ বঞ্চিত হয় তখন মানুষের ভেতর জেগে ওঠা "অমানুষে মানুষ শিকার করবে"।


না,এটা আমার ব্যক্তিগত মনগড়া কথা নয়,এই মূল্যবান কথাটি বলেছেন প্রবুদ্ধ কবি শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য্য তাঁর লেখা "মাস্টারমশাই ও ছাত্র" কবিতার মধ্য দিয়ে।


বিদগ্ধ কবি তাঁর গভীর বীক্ষায় বুঝেছেন,শিক্ষা অর্জনের জন্যে একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রয়োজন।সেই শিক্ষক থাকেন মানুষের অন্তরে।অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো বয়ে চলা জীবনপ্রবাহে সেই শিক্ষক সদা তৎপর।তবে অন্তরে শুধু শিক্ষকের বাস হলে তো হবেনা,কেইবা গ্রহণ করবে শিক্ষকের দান করা সেই মহান জ্ঞান।সুতরাং হৃদয় সাম্রাজ্যে একজন বিনয়ী ছাত্রেরও প্রয়োজন আছে।হাঁ,কবি দেখলেন মহান শিক্ষকের মতো একজন বিনয়ী ছাত্রও বাস করে মানুষের ভেতরে।একজন মানুষের অন্তঃস্থলে শিক্ষক ও ছাত্র নামক দুই গুণী মানুষের সহাবস্থানই হয়ে ওঠে সমাজ সভ্যতার চালিকাশক্তি।ছাত্র যখনই বিপথে চালিত হয় তখনই মহান শিক্ষক তাঁর দান করা জ্ঞানালোকের শাসনদণ্ড দিয়ে তাঁর সন্তানবৎসল প্রিয় ছাত্রটিকে সুপথে ফেরান।
কবি তাঁর জবানিতে বললেন সেই কথা।


"আমাদের সকলের মধ্যে
একজন মাস্টারমশাই আছেন।
একজন ছাত্রও আছে বৈকি।"


কবি একথাও জানাতে ভুললেননা,এই ছাত্র ও মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্কটি নিছক প্রথাগত স্কুল কলেজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়,বরং তার অতীত ভিন্নতর কিছু।স্কুল কলেজের পঠনপাঠনের সঙ্গে সরাসরি পাশফেলের সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে।যা এখানে নেই।এখানে কে কতো নম্বর পেলো তা বিচার্য নয়,বরং এখানে প্রধান বিচার্য হলো পথ।কবি জানাতে ভুললেন না সেকথা।


"সঠিক শিক্ষা পরীক্ষায় পাশ করা নয়,
সঠিক পথে এগিয়ে চলা
আর মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচা"।


সুপথে এগিয়ে চলা এবং মাথা উঁচু করে বাঁচার মধ্য দিয়ে সমাজ সংসারকে এগিয়ে দেওয়াই এই শিক্ষার উদ্দেশ্য।তাই এখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি এতোটাই নিবিড় যে যা অন্য কোনো সম্পর্কের ভেতর দেখা যায়না।প্রিয় ছাত্রটি বিপথে চালিত হলে তাকে কঠিন কঠোর অনুশাসনের মধ্য দিয়ে সঠিক পথে চলিত করে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করা এই মাস্টার মশাইয়ের মূখ্য কাজ।সুতরাং বলা যায় এই মাস্টারমশাই আসলে পরীক্ষার খাতায় নাম্বার পাইয়ে দেওয়ার মেশিন নয়,ব্যক্তি সাম্রাজ্যের অধিশ্বর অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী।


যেহেতু এই মহান সম্পর্কটি দাঁড়িয়ে আছে পথের দিশারী রূপে,তাই কবি তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি থেকে ঝুঝেছেন---


"নিজের ভেতরের এই দুজন মহামানবকে
সদা লালন পালন করা দরকার
একজন হারিয়ে গেলে জীবন অন্ধকার।"


কবির কবিতাটি পাঠ করতে করতে কোথাও যেনো আমরাও কবির উপলব্ধির সাথে একাত্ম হয়ে যাই। অবশ্য শুধু একাত্ম হওয়া নয়,পরক্ষণেই কবি সতর্ক করে দিলেন। যদি আমরা এই দুই মহামানবকে হৃদয়ে লালন না করি তার বিষময় ফল কি হতে পারে এক এক করে কবি তা দেখিয়ে দিলেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে।


"জীবন থেকে যদি ছাত্র হারিয়ে যায়-
কেউ আর শিখতে চাইবেনা
অপঠিত মানুষ বাঁচবে ভেড়ার মতো।"


অর্থাৎ পশুর মতো হবে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই মানবজীবন।পক্ষান্তরে--


"জীবন থেকে যদি হারিয়ে যায় মাস্টারমশাই-
শেখাবার কেউ থাকবেনা;
অপুষ্ট মানুষ ঘুরে বেড়াবে তীর্থের কাকের মতো।"


বিদগ্ধ কবির জবানি থেকে লক্ষণীয়,এখানে কবি শিক্ষাকে পুষ্টির অংশ করলেন।এবং সেই পুষ্টিরসকে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত করলেন জীবনের সঙ্গে।শিক্ষা যে পুষ্টির অঙ্গ তা আমাদের মানতেও আর বাধা রইলোনা।কারণ যার অভাবে সমগ্র জীবন অন্ধকার তাকে তো অবশ্যই বলা যায় পুষ্টিকর সামগ্রী।


এখন পাঠক মনে প্রশ্ন আসে যদি মানবজীবন থেকে ছাত্র ও মাস্টারমশাই দুজনেই হারিয়ে যায় তবে কি হতে পারে মানুষের অবস্থা?সবশেষে এসে দেখলাম  পাঠকের মতো কবিও তা নিয়ে ভাবিত।কবির সম্মুখ ভাবনা কবিকে চেনালো বাস্তব পরিস্থিতি।কবি খোলা চোখে পরিষ্কার দেখলেন--


;শিক্ষা আনন্দবাজার পত্রিকার নিরুদ্দেশের পাতায়;" স্থান নিয়েছে।


হাড়হিম করা অবস্থা মানুষের।কারণ তখন মানুষ আর মানুষ নেই,ভবিষ্যতদ্রষ্টা কবি গভীর বিক্ষায় বুঝলেন তেমন পরিস্থিতিতে মানুষরূপী "অমানুষে মানুষ শিকার করবে"।


ভারি চমৎকার কবিতা।যে কবিতা মানুষ তথা সমগ্র  সমাজ সংসারের ভেতর উৎসারিত আলোর সন্ধান দেয়।সেই আলোয় আমরা পাঠক হিসেবে প্রত্যক্ষ করি মানব মনের আলোকিত দিক।আর যেখানে আলো তার উল্টো পিঠ কেমন তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?আমরা মানুষের সেই তমসাচ্ছন্ন মুখের কথা ভেবে শিউরে শিউরে উঠি।সেখান থেকে নিয়ে যাই কিছু শিক্ষা।কি সেই শিক্ষা?না,যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে মানুষের ভেতর থাকা চিরন্তন দুই মহামানবকে।তবেই সমাজ সভ্যতা আলোকিত হবে।যা এতোদিন হয়ে এসেছে বলেই মানুষ আজও মানুষ।মাস্টারমশাই যেমন প্রণম্য,তেমনই ছাত্রসত্ত্বাটিও মানব মনে স্নেহের আসনে অধিষ্ঠিত।অর্থাৎ একই মানবশরীরে মাস্টারমশাই ও ছাত্র নামক দুই মহামানবের সহাবস্থানের তত্ত্ব কবিতাটির মূল চালিকাশক্তি।
যখন একই শরীরে খেলে দুই মহান আলো
তখন ভোরের আলো ফুটবে ভালো।


যেহেতু "মাস্টারমশাই ও ছাত্র" কবিতাটির মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র ও তাদের মাঝে প্রসঙ্গক্রমে এসে পড়েছে মানবমন।যার ভেতর এই দুই মহামানবের সহাবস্থান।সুতরাং চমৎকার নামকরণ এবং তা সার্থক ।


সহজ সরল কথার আড়ালে এমন একটি গভীর মনোরম কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় গুণী কবিকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।আগামীতে কবির কলমে বিচ্ছুরিত হোক এমনিতর আলো এই কামনা করি