কবিতা--- প্রতিবিম্ব(কবিতাটির গভীরে আত্মদর্শনের সুর কবিতাটির প্রাণ)
কবি--- ফারহাত আহমেদ
আলোচক---রণজিৎ মাইতি
--------------------------------------
জীবন বহমান স্রোতস্বিনী,দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যেতে যেতে সে অনবরত ছড়িয়ে যায় কিছু না কিছু স্মৃতিফুল,পরে কতক হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে।এই যে হারিয়ে যাওয়া এ তো ভিন্ন কিছু নয়,আদতে নিজেকেই হারানো জীবনের রুক্ষ মরুতে। তখন নিজের কাছেই নিজে সম্পূর্ণ অপরিচিত।মরুতে গজিয়ে ওঠা ক্যকটাসের কাঁটায় বিদ্ধ হতে হতে যখন যন্ত্রণাকাতর মুখ
বহুচেনা শান্ত পুকুরের পাড়ে মধ্য দুপুরে
জীবন নামক জলস্রোতের মুখোমুখি হয়,তখন পরিষ্কার দেখেন নিজেরই মুখ কাঁপছে!কবি তখন নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন,কেন এই কাঁপুনি? কবি ভীষণ অবাক হন,স্বতই কবির মুখে উচ্চারিত হয়---


"শান্ত পুকুর
শান্ত দুপুর
আমার ছায়া
            কাঁপছে কেন?"


কবি এড়িয়ে যেতে পারেন না এই প্রশ্ন।তাঁর ভেতর জেগে থাকা সুকুমার প্রবৃত্তি ও কুসুম কোমল মন তাঁকে আবারও জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।


এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে কবিগুরুর বিখ্যাত গান,--
"আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাইনি তোমায়,দেখতে আমি পাইনি
বাহির পানে চোখ মেলেছি,বাহির পানে
আমার হৃদয় পানে চাইনি,আমি চাইনি
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে-----"


জীবনের স্রোতে কখনো কখনো আপন হৃদয়ও হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে, হয়তো আবার হঠাৎ কোনো বিশেষ অনুসঙ্গ চিনিয়ে দেয় আসল জীবন দেবতাটিকে।তখন মানুষ বুঝতে পারেন কোনটি তার প্রকৃত স্বত্তা,যা তাঁর হিয়ার মধ্যেই এতদিন একান্তে বসবাস করেছে নিভৃতে নির্জনে।অর্থাৎ একই রূপের আড়ালে বহুবিধ স্বত্তার অবস্থান।


মনোজ্ঞ কবি ফারহাত আহমেদও তাঁর রচিত "প্রতিবিম্ব" কবিতায় বললেন,জীবননদী বহুমুখী ব্যস্ততায় আপন হৃদয়টিকে অনেক সময় চিনতে পারেননা,কিন্তু জীবন প্রবাহে কখনও হঠাৎ হঠাৎ নিজের সাথেই নিজের দেখা হয়ে যায়,যেভাবে পুরণো বন্ধুর সাথে দেখা হয়। কবির কথায়---


"হঠাৎ করে
আবার সেদিন
আমার সাথে
             আমার দেখা,"


তবে সেই সাক্ষাৎ হৃদয়ের আয়নাতে নয়,লৌকিক। কারণ আয়না হুবহু বহিঃরঙ্গের পরিচয় করায় নিজের সাথে।তাই কবি বলেন,---


"আয়নাতে নয়
ভণ্ডামি নয়
পুকুর পাড়ে
         দেখতে শেখা।"


যেহেতু আয়নায় নির্মিত প্রতিচ্ছবির পুরোটাই ভণ্ডামিতে ভরা।তাই কবি পুকুর পাড়ে অর্থাৎ জীবনের সায়াহ্নে জলের মুখোমুখি হন কোনো এক শান্ত দুপুরে।কারণ তখন পুকুরও তরঙ্গহীন ধীরস্থির শান্ত।তখনই কবি দেখেন তার ছায়া কাঁপছে।


কবির অনুসন্ধিৎসু মন সন্ধান করে কম্পনের কারণ,বুঝতে পারেন এই কম্পন আসলে অন্তঃপুরের উথাল-পাথাল।এখানে লক্ষণীয় স্তবক শেষে 'যেন' শব্দটির প্রয়োগ


"সম্ভবতঃ
অন্তঃপুরের
উথাল-পাথাল
            মাপছে যেন।"


আসলে কবি শুরুতে প্রয়োগ করেছেন 'সম্ভঃবত' শব্দটি,এবং বিদগ্ধ কবি তা সচেতন ভাবেই করেছেন।কারণ কবি জানেন জীবন সম্পর্কে কোনো প্রেডিকসানই একশো শতাংশ নির্ভরযোগ্য নয়।এতো বাঁক,এতো খাদ,গিরিখাদ যে যা যা ভাবা হয় ঠিক,পরোক্ষণেই তা প্রমানিত হয় ভুল।তবে এটা ঠিক,এই কম্পন সত্য।


আসলে কবি প্রতিবিম্ব দেখে এটুকু নিশ্চিত আশৈশব অর্জিত শিক্ষা যেনো জীবনের কোথাও এসে লক্ষ্যভ্রষ্ট।নীতিকথা,নীতিমালা বাস্তবের মাটিতে চৌচির,ফুটিফাটা। তাই জলের ভেতর সমদূরত্বে নির্মিত প্রতিচ্ছবি ও লৌকিক জীবনের প্রতিচ্ছবির মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক,যা অপ্রাকৃতিক,অতিন্দ্রিয়।তাই সহজিয়া কবি স্বাভাবিক ভাবেই বলতে পারেন----


"পানির ভেতর
প্রতিচ্ছবির
মাত্রাটুকু
        অপ্রাকৃতিক
অতীন্দ্রিয়
বলতে পারো
বলতে পারো
         অস্বাভাবিক"


অর্থাৎ বলা যায় আসলের সঙ্গে নকলের অস্বাভাবিক তফাত।


এই অস্বাভাবিকতা কবিকে আবারও মুখোমুখি বসতে বাধ্য করে।


"আমার মুখো-
-মুখি আমি
ভেতর বাহির
           সব দেখা যায়
ভয় পেয়ে তাই
খুঁজতে থাকি
সব লুকাবার
            একটা উপায়"


চোখ রগড়ে দেখেন,না কোথাও ভুল নেই।মানুষের ভেতর ও বাহিরের যেটুকু দেখা যায়, সব এক ও একাকার তো নয়ই বরং গগনচুম্বী ফারাক।তখনই তিনি ভয় পান।আত্মানুসন্ধানের পরিণতি যে এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে তা তিনি কষ্মিনকালেও ভাবেননি।মানুষ হতে চায় এক,হয়ে যায় আর এক।তাই তো দুই ইমেজে এতো ফারাক।তখন মানুষেরই প্রতিভূ গুণীকবিও লুকোন মুখ।হয়তো এটাই মানুষের আসল প্রকৃতি,আত্মগোপন।


কিন্তু যতোই আমরা মুখ লুকোই না কেনো, কোনো ভাবেই কি পাওয়া যায় এর থেকে পরিত্রাণ? ভেতরের স্বত্বাই তো হাতুড়ি পেটায় নিজস্ব হৃদযন্ত্রে।


"ভেতর-বাহির
সব পড়া যায়
সহজ সরল
               ভাষায় লেখা
ঝাপটা মেরে
শেষ করে দেই
আমার সাথে
               আমার দেখা"


সমাধান খুঁজতে গিয়ে পুনঃরায় জীবনবাদী কবি ফিরে আসেন জীবনের কাছে,চান বোঝাপড়ার মধ্যে একটা সহজ সমাধান।এবং এটাকেই জীবনের অমোঘ সত্য মেনে ঝাপটা মেরে ছিন্ন করেন নিজের সাথে নিজের চেনাজানা,পরিচয়।

কবিতাটির মধ্য দিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন মানব জীবনের দুই বিপরীতমুখী স্বত্তার সংঘাত ও সমর্পন।একটা সময়ে এসে মানুষ নিজেই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেননা কোনটা আসল আর কোনটা নকল প্রতিকৃতি।যদিও আসল প্রতিবিম্বটি কখনোই সমর্পনের রাস্তায় হাঁটা পছন্দ করেনা।হয়তো তাই সবশেষে বেছে নেন পৃষ্ঠপ্রদর্শনের পথ।বেদনাদায়ক হলেও এটাই চরম ও পরম সত্য।


ভারি সুন্দর কবিতা,তেমনি চমৎকার নামকরণ।বিষয়ের কথা বাদ দিলেও
কবিতাটির সবচেয়ে যেটা আকর্ষণীয় তা হলো কবিতাটির নির্মান শৈলী এবং ছন্দ ও শব্দের যথাযথ প্রয়োগ।সত্যিই মুগ্ধতা প্রকাশের ভাষা নেই। এমন একটি সুন্দর কবিতা উপহার দেওয়ার জন্যে প্রিয় কবিকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।আগামীতে কবির কলম সাফল্য লাভ করুক এই কামনা করি।
-------------------------
রসিক পাঠকের সুবিধার্থে সম্পূর্ণ কবিতাটি দিলাম
---------
কবিতা---প্রতিবিম্ব
কবি---ফারহাত আহমেদ
----------------------------------
হঠাৎ করে
আবার সেদিন
আমার সাথে
          আমার দেখা
আয়নাতে নয়
ভণ্ডামি নয়
পুকুর পাড়ে
          দেখতে শেখা।
শান্ত পুকুর
শান্ত দুপুর
আমার ছায়া
           কাঁপছে কেন?
সম্ভবতঃ
অন্তঃপুরের
উথাল-পাথাল
             মাপছে যেন।
পানির ভেতর
প্রতিচ্ছবির
মাত্রাটুকু
            অপ্রাকৃতিক
অতীন্দ্রিয়
বলতে পারো
বলতে পারো
                                              অস্বাভাবিক


আমার মুখো-
-মুখি আমি
ভেতর-বাহির
               সব দেখা যায়
ভয় পেয়ে তাই
খুঁজতে থাকি
সব লুকাবার
               একটা উপায়।
ভেতর-বাহির
সব পড়া যায়
সহজ সরল
               ভাষায় লেখা
ঝাপটা মেরে
শেষ করে দেই
আমার সাথে
               আমার দেখা।