💄একদা বনিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে শোষণ করেছিল অখণ্ড ভারত। শত সহস্র শহিদের রক্তস্রোতে ভেসে গেছে তারা সেই  কোন্ কালে। আজও কি বিন্দুমাত্র অবস্হান্তর ঘটেছে প্রান্তিক মানুষের? শত বর্ষ পরেও আজও  "ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে "। যাদের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব ওদের কথা ভাবার সেই স্বাধীন দেশের  শাসকেরাও  তো কেবল ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাটাকেই পাখির চোখ করে রেখেছে আর আমজনতাকে ভেবে এসেছে নিছকই ভোটব্যাংক। তাছাড়া আমরাই বা কতটুকু খোঁজ রাখি তাদের? এই মোক্ষম প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় পাঠককে দরদী কবি গোলাম রহমানের কবিতা "ধুলামাখা জীবন"।


🔰  ধুলামাখা জীবন / গোলাম রহমান 💄


   রূপশালি ধান দেখেছি ধুলি পড়া কবিতার পাতায়,
অভিজাত শপিংমলে বাসমতি চালের দেখা পাওয়া যায়!
কতো ধানে কতো চাল ফলে এই সোনার বাংলায়,
সারা বছর ভরে থাকে বনিকের গোলায় গোলায়!


দিনভর রোদে পুড়ে কেজি তিন পোঁকাধরা মোটাচাল
বেঁধে গামছায় ঘরে ফিরি হরষ চিত্তে,মাথাটায় গোলমাল!
ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়ায় কিবা আসে যায়
জানো নাকি মাটির মানুষের জীবন কেবল ধুলায় গড়ায়!


নিশিথে ছনের চাল ফেঁড়ে মায়াবতী এসে বসে শিথানে
ছুঁয়ে চোখ বলে ‘নিদ যাও! খুঁজে মরো কেন জীবনের মানে’?
                   --------


    💄শিরোনামঃ- কবিতায় ভিক্ষাবৃত্তি উল্লেখিত হলেও মূলত শ্রমজীবি প্রান্তিক মানুষের  ধুলামাখা জীবনের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন কবি। সুতরাং কবিতাটির নামকরণ যথার্থ ।


      💄প্রথম স্তবকঃ- সেই কোন্ কালে ছাত্রজীবনে পাঠ্য কবিতায় রূপশালি ধানের কথা পড়েছিল সে। এখন বাসমতি চাল মেলে অভিজাত শপিং মলে। শুধুই কি চাল ? উন্নত জীবনযাপনের নানান পসরা সাজানো সেখানে । এসবই তার কাছে স্বপ্ন। আক্ষরিক অর্থে এইটুকুই বলা যায়। কিন্তু 'অল্পে অধিক  বলা কবিদের কাজ।' কাজেই বক্তব্য কেবল এইটুকুই নয়। বরং ব্যাপক। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও  লেখাপড়া শেখে। স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনযাপনের । কিন্তু আলোচ্য কথকের দুর্দশা দেশের তামাম শিক্ষিত বেকারের করুণ অবস্থার কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। নিজ মাতৃভূমিতে পরিবার-পরিজনের সংস্পর্শে থেকে যথাযোগ্য কর্মসংস্হান কজনে করতে পারে? কেন তাদের একটা বিশাল অংশকে ভাগ্য অন্বেষনের জন্য আত্মীয়-স্বজনকে ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিতে হবে? দেশে থেকে কেন তাদের ক্ষুণ্নিবৃত্তির জন্য দুর্বিষহ জীবন বেছে নিতে হয় যাদের কাছে  অভিজাত মানুষের জগত গল্পকথা হয়েই থেকে যায় । আবার কবি যখন বলেন, "কতো ধানে কতো চাল ফলে এই সোনার বাংলায়,
সারা বছর ভরে থাকে বনিকের গোলায় গোলায়!" তখন প্রান্তিক চাষিদের দুরবস্থার কথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা ফসলের ন্যায্য দাম পায় না।তাদের  অক্লান্ত পরিশ্রমলব্ধ ফসল চলে যায় বনিকশ্রেণির কবলে। বিষম বণ্টনে সোনার বাংলার সেই সোনার ফসলের উৎপাদনকারীরাই হয় বঞ্চিত; ফায়দা তোলে কেবল মুনাফাবাজ আড়তদারেরা যারা জানেই না কত ধানে কত চাল হয়।


          আবার যদি স্বল্পশিক্ষিত অথবা নিরক্ষর মানূষের  দুর্দশার কথাও ধরি তাহলেও দেশনায়করা তার দায় এড়াতে পারে না। কেন তারা আজও যথাযোগ্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত অবধারিতভাবেই সে প্রশ্ন উঠবে।


   💄দ্বিতীয় স্তবকঃ- স্বাধীন দেশে যথাযোগ্য মূল্য পায় না যার জীবন তার 'মাথাটায় গোলমাল' খুবই  স্বাভাবিক। দিনভর রোদে পুড়ে পোকাধরা চাল পায় কিছু। এই 'রোদে পোড়া' কথাটা ইঙ্গিতবহ। শ্রমজীবি মানুষের কথাই যে কবি বলতে চাইছেন সেটি এখানেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যার দেরাজে আজও ধুলি পড়া কবিতার বই, সে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতে পারে না। পোকাধরা চাল বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে শ্রমের উপযুক্ত প্রতিদান না পাওয়ার কথা। তাদের শ্রমের বিনিময়ে যে সম্পদ সূস্টি হয় তার প্রায় পুরোটাই ভোগ করে অভিজাত শ্রেণি। আর 'মাটির মানুষের জীবন কেবল ধুলায় গড়ায়'। আর যদি ভিক্ষান্নজীবির কথাই ধরি তাহলে বলতে হয় স্বাধীনতার এত বছর পরেও  কেন মানুষকে এমন গ্লানিকর জীবন বেছে নিতে হবে? একদিকে মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে দেশের অধিকাংশ সম্পদ গচ্ছিত হবে আর অন্য দিকে অধিকাংশ মানুষ অভাবের তাড়নায় হীন জীবনযাপন করবে, এটা কেমন বিচার? কেন  এই বৈষম্য স্বাধীন দেশের বুকে?


    💄শেষ স্তবকঃ-  কবি একটি দার্শনিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে।
আর তখনই গোটা কবিতায় ভিন্ন এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপট তথা তাৎপর্যও খুঁজে নেওয়া যেতে পারে। তবে এটুকু বলা যায় যে, অবিচার ও অসাম্যের শিকার তথা জীবনযুদ্ধে পরাজিত কোন মানুষের পক্ষে জীবনের মানে খুঁজতে চাওয়া বেদনার পাল্লা আরও ভারি করা ছাড়া অন্য কোনও তাৎপর্য বহন করে আনবে না। কারণ বহমান জীবনের দিনগত পাপক্ষয়ের বাঁধাধরা পথে হেঁটে যাওয়া ছাড়া তার গত্যান্তর নেই।


    উপসংহারঃ- একদিকে ধুলোমাখা জীবন, অন্য দিকে শপিং মলে যাতায়াতকারী সাফসুতরো অভিজাত শ্রেণির জীবন। উভয়েই একই বিশ্বের নাগরিক। অথচ জীবনযাপনে বিস্ময়কর ফারাক। একজনের জীবন হয়ে ওঠে অর্থময় আর অন্যজন জীবনভরই কেবল জীবনের মানে খুঁজে বেড়ায়। এই যদি  সভ্যতার অগ্রগমনের নিদর্শন হয় তাহলে সভ্যতার সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করা উচিত।