সাইরেন

সাইরেন
কবি
প্রকাশনী আড্ডা প্রকাশন
প্রচ্ছদ শিল্পী এম, আসলাম লিটন
স্বত্ব সানাউল্লাহ সাগর
প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০১৬
বিক্রয় মূল্য ১৪০
বইটি কিনতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

ভূমিকা

“সাধ্য নাই জনপ্রিয় পদাবলী রচনার-হোক বক্তৃতা-স্লোগান অথবা বেডরুমের গনিত। কিন্তু এই লাইনগুলো কি অসত্য বলে হেসে উড়িয়ে দিতে পারবেন!”
শিল্পের সাথে সত্যের যে আন্তঃসম্পকীয় সৎ সুষমা তার মুখোমুখি এনে দাঁড় করালেন উপরোক্ত গদ্যভাষ্যের কাব্যকার ‘সাইরেন’ গ্রন্থের স্রষ্টার কবি সানাউল্লাহ সাগর। বিশ্বরোডের পাশে এক বিকলঙ্ক বিছানায় বসে অথবা শুয়ে শুরু করেছিলাম বিনম্র আবেগে এই গ্রন্থখানার পাঠ।মূলত কবিতার খোঁজে।কাগজের গন্ধসহ কাব্যের ঘ্রাণ আর স্বাদের স্থলে স্মার্টফোন—ল্যাপটপের নানা রশ্মির ছুঁড়ে দেওয়া যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেতেই হাতে তুলে নিয়েছিলাম ছাপাখানার শ্রমিকের ঘামমাখা কাগজে নির্মিত এই বইটি। গত এপ্রিলে আড্ডা প্রকাশনের পথ ছুঁয়ে প্রকাশ্যে আসা মোট চল্লিশটি মলাটবদ্ধ কবিতা। ইচ্ছে থাকার পরও যাদের ভালোবাসার কথা বলা হয়নি... তাঁদের উৎসগ করা হয়েছে বইটি। পাতা উল্টাই পরম্পরায়। চোখে আসে হাল আমলের হকিকতকে ধাক্কা দিয়ে কয়েক পৃষ্ঠার ভূমিকাকথন। এখনকার কবিতার বইয়ে ভূমিকার ভ্রম অথবা সুধা পানের পথ কম দেখা গেলেও এ গ্রন্থে তা পেলাম। কবি মৃণাল বসুচৌধুরীর লেখা ভূমিকার মাধ্যমে পাঠকের প্রি-কন্সেপশন তৈরির যে চেস্টা হয়েছে তা এড়িয়ে বিক্ষুব্ধ পাঠকের মতো সামনে এগুবার পথেও চোখ আটকে যায় ভূমিকাকারের কয়েকছত্র মন্তব্যে— শব্দচয়ন, উপমা ও রূপকের মাধ্যমে কবিতাকে অকারণেই দূর্বোদ্ধ্য করে ফেলেন অনেকে...। সুখের বিষয় এই কবি আপতসরল ভাষায় কিছু কবিতা উপহার দিতে চেয়েছেন তাঁর পাঠকদের...। নিজের বুকের মধ্যেই স্লোগানের জন্মদেন তিনি। কখনো কখনো এই স্লোগানই পরিনত হয় আর্তনাদে, প্রতিবাদদ্বীপ্ত কথামালায়, কখনো বা বিষণ্ন উচ্চারণে...।” আচ্ছা ঠিক আছে আমি সামনে যেতে চাই, যেতে চাই কবিসৃষ্ট সৃষ্টির সংস্পর্শে বাকীসব বাদ রেখে।

বসেছি ব্যক্ত করতে পাঠের পরের প্রতিক্রিয়াটুকু। সুতরাং এখানে কিছু কথা সেরে নিই। কবিতা আসলে কি এ প্রসংগে বোর্হেস বলেন— অথবা বাংলা কবিতার ধারাবাহিক বিকাশ যদি নজরে আনি তবে দেখা যায়... কিংবা বুদ্ধদেব বসু জানাচ্ছেন... জীবনানন্দ বলেছিলেন... রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে... বিনয়ের চাকায় আমরা পাই...একদা লোরকা... বোদলেয়র থেকে শামসুর রাহমান...উপরোক্ত সকল ডট ডট-এ প্রথা আর ক্লিশের কালিমা লেপে দিয়ে আমি হাঁটতে চাই আমার পথে। বলতে চাই প্রেম আছে, দ্রোহ আছে। সাইরেনে আর আছে সমাজ, সংকট আর রাজনীতি সচেতনতা। আছে আপত সীদ্ধান্তে পৌঁছবার কাব্য প্রবনতা। আর হতাশা আছে কী? নাকি ওর নাম বেদনা ? কবি যে বলেছেন—
...জানলাম ভালোবাসা অসুখের নাম।
...ভালোবাসলে ব্যথা পাওনা হয়ে যায়।
অথবা
...জীবন আর প্রেম শুধুই বিকার।
...সাইরেন ভুলে যদি সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে যাই।

হ্যাঁ বেদনা। অভিমান ভরা নিঃস্ব বেহালা বাদকের কপট দুঃখ—উচ্চারণ। কেননা এইসব ক্লেদাক্তি ভুলে, সকল অভিমান হেলায় ঠেলে ফেলে উড়তে উড়তে চলে যাবেন তিনি আনন্দিত শিশুর মতো মুগ্ধ প্রেমিকের বেশে—
...একবার ডাকো না সব ফেলে উড়ে আসবো।

ঠিক এভাবেই জেগে আছেন তিনি। শুনবেন প্রেম হতে সৃষ্ট কম্পন। আর কম্পন থেকে ছুটে আসা সাইরেন। না পেলে, দারুন আশা নিয়ে, প্রত্যাখানের মৃদু ভয় সমেত ছুঁড়ে দিবেন করুন আহবান—
...নিভে যাচ্ছি—যদি একবার আসতে...

বলছি প্রেম ও এইসব প্রেমজ আলাপে নতুন ভাষা বা শব্দ নয় নিত্য দিনের ব্যবহারিত শব্দগুলো সাজিয়েই কেমন আর্তনাদের সুর সাধছেন কবি। আহা! আর একবার পড়িইনা—
...নিভে যাচ্ছি যদি একবার আসতে...

না এসে পারে প্রকৃত প্রেমধারী কোন বুক। আসতেই হয় এমন করুন অথচ সংহত সুরের আমন্ত্রনে। কেননা—
...চেতনা হারানো অলি তবুও স্বপ্নের জাল বুনছে। ছড়িয়ে দিচ্ছে লোভহীন প্রেমের প্রসাদ তাবত রোমিও টেবিলে।

ঠিক এমনসব প্রেম-প্রেম বাক্যে ব্যক্তি কবির নিজস্ব প্রেমজ অভিজ্ঞতার কাব্যিক প্রয়াস ছুঁয়ে যায় সব প্রেমিকের মন। কবির ভালোবাসাও বহুমাত্রিক মানে বহুপাত্রিক। আমরা খুঁজে পাই ভালোবাসা ঘুরে-ফিরে। শৈশবে যদি জেগে থাকে স্মৃতির ‘জেসমিন’, যৌবনে উঁকি দ্যায় চুম্বনের সুরে সেদিন কথা না বলা ‘ইয়াসমিন’। কিংবা আসলে সব নাম সাধারন, প্রেমের আধারে নামহীন আকুতি। হ্যাঁ , আকুতির আলিঙ্গনেই গঠিত গ্রহনের গান, এখানে চলে না কোন-ই দেনা-পাওনার বিজ্ঞান।

এ গ্রন্থের প্রেমময় বাক্যগুলির নিজস্ব শৈলীর সাথে কেউ লীন হতে পারুক বা না পারুক অথবা সার্বজানীনতায় মিশে হয়ে উঠুক এই প্রেমানুভূতিটুক সবার, সে প্রশ্নে কবি ক্লিয়ার করেছেন তাঁর আইডেনন্টিটি—
...আমি ভাই আর্টসের ছাত্র বোকচোদ নাবালোক প্রেমিক।

কবি সমাজে বাস করছেন।ভাবনার প্রতিবেশ প্রভাব ফেলছে প্রতিনিয়ত তাঁর যাপনে। যাপন থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতাকে এড়িয়ে যাননি সানাউল্লাহ সাগর। সমাজ রাজনীতি তাঁর লেখায় বসেছে কখনো প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে, কখনো প্রকট—
...সময়—দুটিনামে ডাকলাম তোমাকে প্রথমে শিকড় পরে সমাজ।

সমাজ পাঠ করতে গেলেই সমকালীন অসঙ্গতি। হু হু করে বেড়ে ওঠা বৈষম্য। সিংহভাগের সংগ্রাম আর গুটি কয়েকের মেদবহুল শরীর কবিকে নাড়া দেয়। নাড়া দেয় বলে তাঁকে লিখতে হয়। লিখতে হয় অস্থির সময়, অভাবনীয় ভন্ডামীর আড়ালে ধর্মের ধমক আর রাষ্টীয় পরকীয়া—
...শাশ্বত বাণী কাঁধে ব্যবসায়ী মাজারে মাজারে।

কবির বুকে যে স্লোগানের ঢেউ ওঠে নানান চাপে তাপে, সমাজ নির্মিত নিয়মের নির্ধারিত নাটকে কখনো হেরে যেতে হয়। পিছু হটতে হয় সরাসরি যুদ্ধ থেকে—
...নিজের মধ্যে স্লোগান তুলে স্বেচ্ছায় ঝুলে পড়ি বড়শিতে।

কবি টের পান সঠিক উচ্চারণগুলো এই বাজারী যুগে কতোটা নিষিদ্ধ—
...আবডাল থেকে এ উচ্চারণ হয়তো অবৈধ!

কবি হয়তো কিছু ভুল বোঝেন বলে ফেলেন সামান্য স্ববিরোধী কথা—
...অন্তরের রাজ্য এখনও চিনে উঠতে পারিনি সমাজ-সংসার রাজনীতি সেতো বহুদূর।

কিন্তু একবিংশের বাজার অর্থনীতি যেমন নিয়ন্ত্রন করছে রাজনীতি আর সমাজ। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় আরো সুক্ষ¥ভাবে ঢুকে পড়ছে সে মানুষের অন্তরের রাজ্যে।এমন কাঠমোতে প্রভাব সৃষ্টি করেই তারা নিরঙ্কুশ রাখছে বাণিজ্যের প্রক্রিয়া। হ্যাঁ , কবি হয়তো নিজেকে চিনে নিয়ে সেইসব বায়বীয় কালিমা মুক্ত হয়ে তারপর তাকতে চান বাইরে। তাকান বাইরে। রাগে-ক্ষোভে এই, ভূখ-ের বাস্তব মাঠে প্রগতির ঝা-াবাহীদের বেঈমানী তাকে ক্ষুব্ধ করে—
...প্রগতির রাজনীতি ভন্ডামীর বীজতলা!

আবার তিনিই ফিরে আসেন। ভালোবাসেন তাঁদের যারা এখনো লেগে আছেন মুক্তির মিছিলে। জানান লাল স্যালুট—
...সত্য যারা স্বীকার করে তাঁদের প্রতি লাল স্যালুট জানাতে ভুলে যাই না কখনো।

কবি জানেন সংসারের সমসাময়িক রীতি। জানেন তাঁর নাগরিক পরিচয়—
...আমি তৃতীয় বিশ্বের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক।

এজন্য প্রেম ও সমাজ পাঠের পর যে পঙ্ক্তি সকল কেবল কাব্যগুনেই, তার অন্তর নিহিত সৌন্দর্যের কারণেই,অতিনির্মানের বাহুল্য ছাড়াই সুন্দর সত্য এক মায়াময় কাব্যঅনুভূতি এনে দিলো।
আমার মুখ ফুটে অজান্তেই বেরিয়ে এলো আহা! এমন কিছু পঙ্ক্তি তুলে ধরবো। এসব পঙ্ক্তি শুধু পড়বো। কোন কথা নয়।
... খুন হয়ে যাওয়া স্বজনের শার্ট আমার আয়না।
...জ্বলন্ত চিতায় ডুবিয়ে দুধহাত তুলে আনি অতিসত্যের তা¤্রলিপি।
...মাঠের নিঃসঙ্গ আলোয় হাটভাঙা শব্দের করুন আকুতি।
...লুকানো রোগগুলো সম্মুখে এসে আরোগ্যের বাহানা নিয়ে হাসছিলো।
...বাকীটা শৈশবের দুর্বোদ্ধ আরবী ভাষা।
...কাঁদলে বৃষ্টি হয়—বৃষ্টি হলে কান্না পায়।
...ঘুমালে জেগে থাকে আর্তনাদ...অমি থামলেই থেমে যায় পথ।

উল্লেখিত পঙ্ক্তিগুলো কবিতার বুক থেকে তুলে এনে আলাদা করে বসিয়ে কিছুটা শিল্পহানি ঘটলো। যে পঙ্ক্তি যে কবিতায় গাঁথা ছিলো সেখানে পড়তে গিয়ে বুঝেছি তাঁর পূর্নস্বাদ। কেননা সানাউল্লাহ সাগরের কবিতায় আছে টোটালিটি। পরম্পরাহীন বুদ্ধি খাটানো অতিনির্মানের বাহুল্যতা নেই। সমগ্র কবিতা মিলে একটি অনুভূতি। প্রচলিত শব্দের আবেগী বিন্যাসে অনুভূতিকে উস্কে দেবার প্রাকৃতিক চেস্টা। গদ্যভাষ্যে রচিত সবকটি কবিতা পাঠের পরে, তাঁর বিষয় ও প্রবণতা জানবার পরে শিল্প উত্তীর্ণ যে সকল পঙ্ক্তিমালা দিলে ধাক্কা দিলো সেটুক আস্বাদনের পরে এ গ্রন্থ মহাকালের সামনে রাখা হলো। মহাকাল বুঝে নিও এখানে ভনিতা নেই আছে সরলতা। বুদ্ধিধর খেলায় নির্মাণের নামে পরম্পরাহীন মিস্ত্রির তৈরি বিল্ডিং নয়। ইহা প্রকৃত হৃদয়ের আর্কিটেকচার। লিপিবদ্ধ নিময়ের সামনে ‘সাইরেন’ দাঁড়াতে চায় না। চিৎকার করে বলে—
... সব পথ সতর্কতাকে সম্মান দেখায় না।

আজকের সানাউল্লাহ সাগর আগামীতে আসবে আরো নতুন আরো প্রকৃতির সৌরভ নিয়ে সে প্রত্যয় কবির নিজস্ব। তিনি বলেছেন—
...শৈশবে লাল রঙ অতিপ্রিয় ছিলো— কৈশোরে গোলাপী— আর পূর্ণ যৌবনে কালো। এই রঙখোলা ধারাবাহিক হলে প্রতি দশক হবে আমার নতুন রঙের।

প্রত্যাশায় রইলাম।

লেখা : নিখিল নওশাদ

উৎসর্গ

ইচ্ছে থাকার পরও যাদের ভালোবাসার কথা বলা হয়নি

কবিতা

এখানে সাইরেন বইয়ের ৩টি কবিতা পাবেন।

শিরোনাম
মন্তব্য