আলোচনা  ২৩০


কবিতাটি পড়ার পর, আবার বেশ কয়েকবার পড়লাম, একটু কঠিন মনে হলো, অনেকগুলো ভাবধারার সংমিশ্রিত বক্তব্য, রূপকতো বটেই। কিন্তু এক অংশের সাথে অন্য অংশের সম্পর্ক কি, সেটাই ভাবছিলাম, ভাবতে ভাবতেই, অনেকগুলো মন্তব্যও পড়া হলো, একেকজন একেকভাবে ব্যাখা করেছেন, মন্তব্য করেছেন (যদিও কাছাকাছি)-


• জীবনবোধের গভীরতা, পর্যবেক্ষন এবং উপলব্ধি
• শিক্ষামূলক কাব্য
• মানবতাবাদী, জীবনবোধ এবং প্রেমের কবিতা
• কুসংস্কার
• জীবনবোধের নান্দনিকতা
• জীবনবোধ এবং প্রেমগাথা ইত্যাদি


কবিতার শুরুটা হলো, একটি সংস্কার দিয়ে (কুসংস্কার এবং সংস্কার নিয়ে নানা মতভেদ আছে), তারপর চলে আসলো আয়নায় প্রতিবিম্ব। ভাবছিলাম, এটা কি  সদ প্রতিবিম্ব (real image) নাকি অসদ প্রতিবিম্ব।  (vertual image), ভাবতে ভাবতেই- মনে এলো এখানে চারটি বিষয় (ইস্যু) নিয়ে লেখা হয়েছে এবং ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্তঃসম্পর্ক (intra relationship) এবং আন্তঃসম্পর্ক (inter relationship) কিভাবে সংযুক্ত হয়েছে। (কবি’র ভাবনার সাথে আমার বিশ্লেষনের ভিন্নতা থাকতেই পারে)। আমার ভাবনায় চারটি ইস্যুঃ


১। সংস্কার এবং মানব আচরন
২। মানুষের মন এবং শরীর (ভেতর এবং বাহিরের মানুষ)
৩। ভালোবাসা এবং সম্পর্কের ভিত্তি
৪। স্বাধীনতা দ্বারা প্রভাবিত-প্রকাশ করা এবং লুকানোর চেষ্টা


মানষের হৃদয় নানা কারনে ভেঙ্গে যায় মানে মানুষিকভাবে বিপর্যস্ত এক অবস্থা তৈরি হয়, সেটা কখনো নিজের ভুলের কারনে হয় আবার কখনো বা অন্যের কারনেও হয়। দুটো ক্ষেত্রেই মানুষের কিছু শিক্ষা হয়, অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। নিজের ভুল্গুলো শুধরে সামনে এগিয়ে যেতে পারে আবার অন্য মানুষকে চেনা হয়, ভবিষ্যতে মানুষের সাথে সম্পর্ক অর্জনের ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি হয়। ফলে ভেঙ্গে যাওয়া মানেই সব সময় খারাপ কিছু নাও হতে পারে, ভেঙ্গে যাওয়ার মধ্যেই মঙ্গল নিহিত থাকে অনেক সময়। সম্ভবত সেখান থেকেই সংস্কার তৈরি হয়েছে, কাচ ভেঙ্গে গেলে আসন্ন বিপদ দূর হয় অর্থাৎ সম্পুর্ন কাঁচ আপাত দৃষ্টিতে কোন খারাপ লক্ষন না হলেও তার মধ্যেই হয়তো বা কোন খারাপ কিছু লুকানো আছে, ফলে তা ভেঙ্গে গেলেই নিরাপদ- এরকম একটা সংস্কার মানুষের মধ্যে আছে যদিও তার কোন বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখা নেই এখনো পর্যন্ত। পুরোটাই মানুষের কিছু অভিজ্ঞতার সাথে মিলে যাওয়াতে এমন সংস্কার তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগ সংস্কারই মানুষের নিজের অভিজ্ঞতা প্রসুত কিংবা অন্যের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রচলিত হয়ে থাকে।


মানুষের মনের সাথে চেহারা পালটায় কেন? আবার উল্টোও হয়, মন পাল্টানোর কারনে চেহারাও পালটে যায়। মানুষের ভেতর এবং বাহিরের মধ্যে একটা অন্তঃসম্পর্ক আছে, আবার আন্তঃসম্পর্কও আছে। মনে মনে যা ভাবা হয় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার আচরনে, তার ব্যবহারে অর্থাৎ শরীরে। খুব রেগে গেলে, কারো প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করলে, চেহারায় তা ফুটে উঠে। আয়নার সামনে দাড়ালেই, প্রতিবিম্বে তা পরিস্কার বোঝা যায়। আবার আক্ষরিক অর্থেও, শরীরের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মনেরও পরিবর্তন হয়। যুব বয়সে মনের ভাবনা আর প্রবীন বয়সে মনের ভাবনায় ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। ফলে বাইরের পরিবর্তন ভেতরে পরিবরর্তনে প্রভাবে ফেলে, আয়নার সামনে দাড়ালে সেটাও দেখা যায়। এই যে ভেতর আর বাহির  অর্থাৎ মন আর শরীর, তার সাথে আবার বাহ্যিক  বা পারিপার্শিক অবস্থা সম্পর্কিত। এই যে অন্তঃ এবং আন্তঃ সম্পর্কের লুকোচুরি খেলা সেটাও আয়নার প্রতিবিম্বে দেখা যায়, রূপকতার ক্যানভাসে।


ভালোবাসার সাথে মনের সম্পর্ক আর শরীর সে তো তাৎক্ষনিক চাহিদা পুরন মাত্র। তাই কবির উচ্চারন-“ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক, অনেকটা দায় মনে হয়”। যেখানে মন থাকে না, সেখানে আর ভালোবাসা থাকে কি করে? তখন আয়নায় কি নিজের সুখের চেহারা দেখা যায়? প্রতিবিম্বে কি আর সুখ ফুটে উঠে, অন্যরা হয়তো বুঝতে পারে না, কিন্তু নিজে নিজের প্রতিবিম্বে সুখ খুঁজে পায় না। তখন সুখও স্বাধীনভাবে উড়তে চায়, নিজের বন্ধনে আর থাকতে চায় না।


নিঃসন্দেহে কবিতাটি গভীর এক জীবনবোধ থেকে উৎসারিত, আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে জীবনের এতগুলো অনুষঙ্গ অন্ত এবং আন্ত সম্পর্কিত করে একটি রূপকের মাধ্যমে উপস্থাপন, সত্যিই বিরল এবং অসাধারন মেধার পরিচয়।


কবির জন্য রইলো অশেষ শুভেচ্ছা।