“এভাবেই আমার দিন রাত্রির অধীরতা
অনেক বনের মধ্য দিয়ে
অনেক নদী সমুদ্রের স্বচ্ছতায়
একদিন হয়তো পাহাড়ের দুর্গমতায়
পাথরের নিশ্চেতন সংকট পার হয়ে
ইউলিসিস ইথাকায় ফিরবে ।
(প্রার্থনা, একক সন্ধ্যায় বসন্ত)”


“রাত্রিতে হারিকেন জ্বালিয়ে তারা শুয়েছিলো
শোবার আগে হেসেছিল এবং প্রদীপের শিখা
বাতাসের গান স্মরণ করেছিলো । কি করে
অন্ধকার হতে হয় রাত্রি তা জানতো এবং
বনভূমি জানতো কি করে রহস্যময় হতে হয় ।
এবং ঘুমুতে যাবার আগে মানুষগুলো জানতো
কি করে গায়ে চাদর টেনে দিতে হয় ।
(উরিরচর, একটি সমুদ্রেই যাবো)”


বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কবি সৈয়দ আলী আহসানের রূপক নির্ভর উল্লিখিত কবিতাদ্বয়ে ব্যবহৃত বিমূর্ত উপমার কারুকাজ, স্থাপনা কৌশল যে কোন সচেতন পাঠককে মুগ্ধ করবেই ।


জীবনানন্দ দাশের রূপক কবিতায় ব্যবহৃত নান্দনিক উপমা বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ ও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়, যেমন নিচের কবিতাগুলি সচেতন পাঠকের অনুভূতিতে গভীর স্পর্শ মেখে দেয়ঃ


“দূরে কাছে কেবলই নগর ঘর ভাঙে;
গ্রামপতনের শব্দ হয়;
মানুষেরা ঢের যুগ কাটিয়ে দিয়েছে পৃথিবীতে,
দেয়ালে তাদের ছায়া তবু
ক্ষতি, মৃত্যু, ভয়,
বিহ্বলতা ব’লে মনে হয়।
এ-সব শূন্যতা ছাড়া কোনো দিকে আজ
কিছুই নেই সময়ের তীরে।
(পৃথিবীলোক, জীবনানন্দ দাশ”


“সে যেন দেখেছে মোরে জন্মে জন্মে ফিরে ফিরে ফিরে
মাঠে ঘাটে একা একা, - বুনোহাঁস - জোনাকীর ভিড়ে!
দুশ্চর দেউলে কোন্‌ - কোন্‌ যক্ষ প্রাসাদের তটে,
দূর উর-ব্যাবিলোন্‌ - মিশরে মরুভূ সঙ্কটে;
(অস্তচাঁদ, ঝরাপালক, জীবনানন্দ দাশ)”


“হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে !
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান মুখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে;
হায় চিল সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে।
(হায় চিল, বনলতা সেন, জীবনানন্দ দাশ)”


ভাষার ক্ষেত্রে রূপক(Metaphor), উপমা(Simile) এবং সাদৃশ্য/অনুকরণ(Analogy)-এর ব্যবহার অজানাকে জানতে সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করে এবং সংশোধন ও সংযোগ শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বিদ্যমান জ্ঞান, জটিল বা বিমূর্ত ধারণা বা পদ্ধতিগুলির ব্যাখ্যা সহজ করে তোলে ।


কবিতা বা সাহিত্যে রূপকের আশ্রয় ভাব প্রকাশের শক্তিশালী হাতিয়ার । কবিতা বা সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় রূপক, উপমা এবং সাদৃশ্য শব্দ তিনটি খুবই কাছাকাছি ও পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে অবস্থান করে এবং রূপকালংকারের মধ্যে
উপমা(Simile) ও সাদৃশ্য(Analogy)অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে একটির সাথে আরেকটি মিলিয়ে ফেলার সাধারণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় । অথচ, রূপক, উপমা এবং সাদৃশ্য তিনটি শব্দের মধ্যে নির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে ।


এখন জেনে নেয়া যাক ‘রূপক বা Metaphor’ কি ?
  
‘রুপক’ হলো একটি বক্তব্য যেখানে একটি জিনিস ব্যবহার করে অন্য অর্থ বোঝানো হয় এবং একাধিক বিষয়ের মধ্যে তুলনা করা হয় । এক কথায় ‘রূপক’ হলো একটি জিনিস বা কিছুর অন্য মানে ।


যেমন ধরুন কেউ যদি বলে, "সে একজন মানুষের সেল হয়ে গেছে", তখন আমরা এটাকে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করি না, যদিও এটি সরাসরি বলা হয়েছে । এ বক্তব্যটি আসলে তার অভ্যন্তরীণ পদার্থ হারিয়ে ফেলার ভাষ্য ।


‘উপমা’ হলো নতুন কোন অর্থ সৃষ্টির লক্ষ্যে দু’টি ভিন্ন জিনিসের তুলনা করা । এক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার যে ‘মত’ বা ‘যেমন’ এরূপ শব্দ ব্যবহার করে তুলনা করা হয় ।


উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, “তিনি একজন মানুষের সেলের মত” । এক্ষেত্রে কেউ যদি সংশোধন করে বলতে চায় “এটা একটি রূপক, উপমা নয়”, তাহলে উত্তরে বলতে হয় “উপমা এক ধরণের রূপক, ঠিক যেমন বিড়ম্বনা এক ধরনের বিদ্রুপ” ।


‘সাদৃশ্য’ ‘রূপক’ ও ’উপমা’-এর সাথে তুলনাযোগ্য, এর মাধ্যমে কিভাবে দুটি ভিন্ন জিনিসকে একই রকম দেখানো যায়, কিন্তু তা আরও বেশি জটিল । একটি যৌক্তিক বিবেচনা বা তর্কের দিক থেকে বক্তব্যের চেয়ে ‘সাদৃশ্য’ বেশি কিছুকে নির্দেশ করে । এক্ষেত্রে কবি বা উপস্থাপক বৈশিষ্ট্য উল্লেখপূর্বক দেখাতে চায় যে কিভাবে দু’টি জিনিস বা বিষয় একই রকম ।


যেমনঃ “গাছের পাতা যত
                 ফুলও যেনো তত ।”


কোন কোন পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করার জন্য উপমা(Simile) বা  সাদৃশ্য(Analogy)-এর আশ্রয় নেয়া বেশি উপযুক্ত বলে মনে হয় । কিন্তু, কবিতার ক্ষেত্রে যুৎসই রূপকের ব্যবহারে অনেক বেশি ভাব ও অবস্থাকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করা সম্ভব হয় ।


রূপক(Metaphor)-এর বক্তব্য সরাসরি, তাই উপমা বা সাদৃশ্য থেকে তা অধিক শক্তিশালী হয় । প্রকাশ্য তুলনার জন্য ‘মত’ বা ‘যেমন’ - এরূপ শব্দ ব্যবহার করা হয়, যা সচেতন পাঠকের মনে অঙ্কন করতে চাওয়া দৃশ্য বা ছবির উজ্জ্বলতা কমিয়ে দেয়। অন্যদিকে স্পষ্ট রূপক সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করা ছাড়াই সচেতন পাঠকের বোধগম্যতায় স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।


সুতরাং, রূপক কবিতার ক্ষেত্রে বলা যায় -


       “রূপক কবিতা এক দৃশ্যমান পুকুর
        তবে সেখানে সাগরের গভীরতা ।”