# কবিতায় গণিত


গণিত প্রকৃতপক্ষে এক উচ্চতর ভাষা ব্যবস্থা- স্বতন্ত্র,স্বয়ংসম্পূর্ণ।এই যে আমরা জগতের অনেক কিছুই বুঝতে পারিনা,তার অন্যতম কারণ হল ভাষার সীমাবদ্ধতা ।তাদের বোঝার চেষ্টা চলে গণিতের ভাষা দিয়ে।কবিতাও কি তাই নয় ?
একটি কবিতা বিকশিত হতে হতে উৎকর্ষের দিকে যেতে যেতে ,এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় বিশুদ্ধ গণিতের দশায়।তখন কবিতা হয়ে ওঠে গণিতের মতো মেটাফিজিক্যাল।একটি আদর্শ অথচ বিমূর্ত এলাকা গড়ে তুলতে চায় উভয়েই ।


গণিতের এই সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা ইউরোপ, আমেরিকায় বহুকাল যাবৎ লেখা হচ্ছে।যেমন,কার্ল স্যান্ডবার্গের 'অ্যারিথম্যাটিক',
ওয়ালেস স্টিভেন্সের 'ল্যান্ডস্কেপ ফাইভ',লিন্ডসের 'ইউক্লিড' ইত্যাদি।
পোল্যান্ডের কবি উইসলাভা সিমবোরষ্কা  ১৯৬৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন  কবিতায় গণিতের রহস্য একীভূত করার জন্য ।
ওমর খৈয়াম ও এমিলি ডিকনসনও গণিতের সৌন্দর্যের বনেদে গড়ে তুলেছিলেন তাদের কাব্য।


বাংলা ভাষায় কাব্যে গণিতের ভাবনা নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথামেটিকস
পাঠরত ছয়জন ছাত্র হঠাৎ খুঁজতে শুরু করেছিল সাহিত্যে গণিত এবং গণিতে সাহিত্য ।এ ধরনের সাহিত্যকে তারা প্রথম নাম দেন 'গাণিতিক সাহিত্য'।জানুয়ারি, ১৯৮০ তে তারা এ বিষয়ে প্রথম প্রকাশ করেন 'ছয়' নামে একটি পত্রিকা।তারা ছয়জন কে কে ছিলেন তা আজ আর জানা না গেলেও জানা যায়, চিরঞ্জয় চক্রবর্তী, অনুপ সেনগুপ্ত এবং মানস বসুর নাম,যারা প্রথম থেকে এই পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন।যুক্ত ছিলেন মিহির চক্রবর্তী নামে এক অধ্যাপকও।


অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিনের পরিণতি যা হয়,এক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম হয় নি।মাত্র সাতটি সংখ্যা বেরিয়ে তিন বছর পরই বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি।এই স্বল্প সময়কালে বাংলা সাহিত্যে গাণিতিক সাহিত্য এক আলোড়ন ফেলতে সমর্থ হয়েছিল,তার প্রমাণ সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আলোচনা- সমালোচনা থেকে পাওয়া যায়।গাণিতিক সাহিত্য,সাহিত্য জগতে নিঃসন্দেহে  এক আন্দোলন ছিল,বলাই যায় ।


কবিতায়, গণিতের উজ্জ্বল উপস্থিতি ঘটেছে  একমাত্র বিনয় মজুমদারের হাত ধরে। তিনি ছিলেন একাধারে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার,গণিতবেত্তা ও কবি।যিনি মনে করতেন 'কবিতা ও গণিত একই জিনিস' এবং সারাজীবন এই বোধ তাঁকে তাড়িত করে গেছে।ক্যালকুলাস,স্থানাঙ্ক জ্যামিতি,
ঘনমূল প্রক্রিয়ার উল্লেখ মাঝে মাঝেই এসেছে তাঁর কবিতায় গণিত হিসেবে নয়,অবশ্যই কবিতা হিসেবেই।
তাঁর একটি কবিতার নামই হল'আমি গণিত আবিষ্কর্তা'। কবিতার শুরুর পঙতিগুলি এ রকম :


'আমি গণিত আবিষ্কর্তা,আমার নিজের আবিষ্কৃত
ঘনমূল নির্ণয়ের পদ্ধতিটি বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক গণিতে
অন্তর্ভুক্ত আর পাঠ্য হয়ে গেছে যেটি
ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর সব বিদ্যালয়ে
পাঠ্য হবে।'


আর একটি গাণিতিক কবিতা:
'X,Y ও Z


দুটো ভ্যারিয়েবল   X ও Y
X ও Y থেকে তৃতীয় একটি ভ্যারিয়েবল
বানাতে চাই আমরা।
তৃতীয় ভ্যারিয়েবল Z সহজেই বানানো যায়
ক্যালকুলাসের দ্বারা।
একমাত্র ঐ ক্যালকুলাসের জন্যই ময়ূরীর
সন্তান আরেকটি ময়ূরীর হয়--
ডিম থেকে ময়ূর হয়,তারপরে Z হয়.....'.


শেষে,সহজ গণিত মেশানো বিনয় মজুমদারের একটি কবিতা,'একটি গান':


X=0
এবং  Y=0
বা,X=0=Y
বা, X=Y


শূণ্য  0 থেকে প্রাণী X ও Y সৃষ্টি হলো
এভাবে বিশ্ব সৃষ্টি শুরু হয়েছিল।


এবার কবি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা 'অবন্তিকা ,তোর ওই মহেঞ্জোদরোর লিপি উদ্ধার'।
কবিতাটা এরকম :


'কী গণিত কী গণিত মাথা ঝাঁঝাঁ করে তোকে দেখে
ঝুঁকে আছিস টেবিলের ওপরে আলফা গামা পাই ফাই
কস থিটা জেড মাইনাস এক্স ইনটু আর কিছু নাই
অনন্ত রয়েছে বটে ধূমকেতুর জলে তোর
আলোকময় মুখ
প্রতিবিম্ব ঠিকরে এসে ঝরে যাচ্ছে
রকেটের ফুলঝুরি জ্বলে।
কী জ্যামিতি কী জ্যামিতি ওরা ওরে
ইউক্লিডিনী কবি
নিঃশ্বাসের ভাপ দিয়ে লিখছিস
মঙ্গল থেকে অমঙ্গল....'


বাংলাদেশে একটি কবিতা পাচ্ছি 'গণিত শিল্পীর ভাবনা ',কবি সইদুল সরকার:


...তাই ভেবেছি --গণিত শিল্পী
হয়ে তোমার শরীরের
অ- উক্লিডীয় জ্যামিতিক অবয়ব
সৃষ্টি করে কনটিন্যুয়াম হাইপথেসিস
থিওরী দিয়ে সোজা প্রবেশ করবো
তোমার হৃদয়ে।
তারপর তোমার হৃদয়ের
অসীমতা নিয়ে আঁক কষতে
ক্যালকুলাসের লিমিট থিওরী
কষাকষি করতে করতে
এক ভালোবাসার মহাগণিত সৃষ্টি করবো...


সবশেষে, অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ।তাঁর' গণিতের রিলেটিভিটি প্রমাণের ভাবনায়' কবিতার কিছু অংশ:


গণিতের রিলেটিভিটি প্রমাণের ভাবনায়
দিনরাত একা ব'সে কাটালো সে পাবনায়,
নাম তার চুনিলাল,ডাক নাম ঝোড়কে।
.......
যোগ যদি করা যায় হিড়িম্বার চুক্তিতে
সে কি ২ হতে পারে গণিতের গুনতিতে।
যতই না কষে নাও মোচা আর মোড়কে
তার গুনফল নিয়ে আঁক যাবে ভড়কে।



ঋণ:
বিনয় মজুমদার:কবিতার বোধিবৃক্ষ-
মলয় রায়চৌধুরি।