(১)
ঊষার কালেতে ডাকিল কোকিল
বসন্ত এসেছে পারে;
সেই সুখ বুঝি নহে সহিবার-
কাক ডেকে গেল দ্বারে।
আজ অলক্ষণে কোন সে খবর
আসিবে এবার কানে;
সারাদিন বুঝি আজ কেটে যাবে
তাহার সকল টানে।


ভাবিতে ভাবিতে টিকটিকি ডাকে
আমার ঘরের চালে;
আশুদা'র মাতা মারা গেছে আজ
খবর আসে সকালে।
দূরের সে গ্রামে ছুটে যেতে হবে
সাথে লয়ে প্রিয়জন;
কত কথা আজ মনে পড়ে যায়
কত তার আয়োজন।


মূলপথ ছেড়ে গ্রামের সে পথ
আঁকাবাঁকা ডানে-বায়ে;
ওইখানে আজ আশুর জননী
শুয়ে উঠানের ছায়ে।
ধীরে ধীরে যাই, নীরব সে পথ
সবে দেখে মোর দিকে;
আমি বুঝি তার কোনো আত্মীয়
তাই ভেবে সবে দেখে।


          (২)
বাড়ির পথেতে কত গাছপালা
সবুজ শ্যামল দিঘি;
এই বুঝি রূপ প্রিয় বাংলার
এখানে জুড়ায় আঁখি।
ভিটার পরেতে আশুর মায়ের
জনম দুখিনী ঘর;
এই বুঝি তার শেষের সম্বল
এখানে আপন পর।


একদিন সেই পনেরোর মেয়ে
পড়েছে হাতেতে শাঁখ;
রসিক দুলাল ঘরেতে আনিল
চেয়ে চেয়ে হতবাক!
মাঝে কেটে গেছে ষাটটি বছর
এক উঠানের পারে;
কবে সেই সুধা হল আশুর মা
দাঁড়াল গায়ের দ্বারে।


সারা বাড়ি জুড়ে কত লোকজন
গাঁয়ের সব মানুষ;
ভিড় করে সব বিলাপ করিছে
কেউ ভাবেতে বেহুস।
চেনা বাংলার নারী মুখগুলি
জড়ো হয় এক থানে;
আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে কেউ
সময়ের খোঁজ জানে!


          (৩)
উঠানের মাঝে মাদুর পাতিয়া
আশুর মায়ের দেহ;
পরম আদরে কেঁদেই চলেছে
পাশে বসে কেহ কেহ।
একখানি ওই সাদাশাড়ি আজ
উঠেছে বসন পরে;
ফুলের মালিকা, তুলসি পাতায়
আপনে মিশেছে ধরে।


বাঁশের মাচাটি নিয়ে আসে সবে
নিয়ে আসে সাথে দড়ি;
কিছু খই, পাতা, জল আর মাটি
রেখেছে হাতেতে ধরি।
যুবক সবাই, গাঁয়ের লোকেরা
এসেছে সাদরে ভাসে;
বেঁধেছে গামছা দেহের উপর
যাবে শ্মশানের পাশে।


হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে চলে মেয়ে
এসেছে খবর শুনে;
এই রূপ বুঝি আজিকে দেখিবে
হিসাব করেনি গুনে।
ঘর দাওয়ায় একেলা ও আশু
মাঝে মাঝে শ্বাস ছাড়ে;
হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে আজ
মাকে ছেড়ে বারেবারে।


        (৪)
দৈন্যের দায়ে নয় বিলাসিতা
কোনো ক্রমে দিন চলে;
জমানো কিছুটা ও বাস্তুভিটা
কেমনে মেলাবে জলে।
রসিক স্বামীটি মারা গেল শেষে
ভুগিয়া বছর দশ;
তারপর থেকে ওই সংসারে
এসেছে শুধুই ধ্বস।


আজ আসে সব প্রিয় মুখগুলি-
বলিছে কতই কথা;
কীভাবে তাহার পরান নিভিল
কী ছিল তাহার ব্যথা।
কিছুদিন ধরে উঠিতে পারেনা
শুধুই শুইয়া থাকে;
ঘরের মাঝেতে দরকার হলে
আশুকেই শুধু ডাকে।


কেঊবা বলিছে ভালোই হয়েছে
কেইবা তাহারে দেখে!
ঘরেতে ভুগিয়া মরণের চেয়ে
শান্তিতে গেল রেখে।
রাতে যদি হত মরেই থাকিত-
দেখিত সকালে এসে;
ভালোই হয়েছে; জল, নাম পেল
কতজনে ভালোবেসে!
      
       (৫)
আজ বুঝি তাই মুক্তিই পেল
আশুর মায়ের প্রাণ;
লেপা হয় নাই, মোছা হয় নাই-
ফাটিয়াছে এ উঠান।
তারি একপাশে ঘরের ছায়েতে
আশুর মায়ের দেহ;
বাস্তু ভিটার আম-কাঁঠালেরা
দুলে দুলে দেয় স্নেহ।


খোল-করতাল নিয়ে চলে আসে
গ্রামের নামের দল;
দেহটির পাশে হরিনাম করে
দেখিয়া মানুষে ঢল।
খোলের আওয়াজে সব লোক আসে
একা একা বলে কথা;
প্রাণের দোসর বন্ধু সকল
পেয়েছে বেজায় ব্যথা।


বেলা বেশি হয়, রোদ্দুর ওঠে
দেহ যাবে ও শ্মশানে;
আর দেরি নয়, হরি হরি বোল-
সমস্বরে সেইখানে।
শেষযাত্রায় সবে মিলে যায়
আশুও দিয়েছে কাঁধ;
কতনা আচার, কত উপচার
যার যেটা ছিল সাধ।


        (৬)
সারাটি গ্রাম কাঁধেতে চাপিবে
এইতো গাঁয়ের রীতি;
সব লোক এসে চেয়ে চেয়ে দেখে-
দেহ চলে সাথে গীতি।
খোল করতালে পুণ্য সে বেলা
চোখের সামনে সত্য;
সোনার বাংলা, সুন্দর ধরা
জাগিবে আজিকে নিত্য।


দল চলে যায়, পথ ঘুরে আসে
আর যে যায় না দেখা;
আশুর মায়ের এ পদচিহ্ন
এখানে থাকিল লেখা।
পোড়া মন্দির বড়ো বটগাছ
রাধেশ্যামের ঢাল;
আশুর মায়ে যে মিলিয়ে গেল
মেলাল চিরটিকাল।


উঠানেতে আর ক্রন্দন নেই
শান্ত সে পরিবেশ;
নিত্যকাজেতে মেতেছে সবাই
ধরেছে আপন বেশ।
গাছ গাছালিরা সবুজ পাতায়
দুলিছে আপন টানে;
দুখানি সে হাঁস ভেসে ভেসে খেলে
চিরদিন তার গানে।
     ---------