ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-৭, ভাগ-৭০> – কবিতার নানা রূপ (বিদেশি ছন্দবন্ধ)
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
-------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ – রঁদো, রঁদেল ইত্যাদি।
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি জি এম শাহিদুল ই্সলাম মহাশয়কে।              
------------------------------------------------------------------------------
রঁদোঃ
সাধারণভাবে তেরো পঙক্তির কবিতা। যথাক্রমে পাঁচ, তিন ও পাঁচটি পঙক্তির তিনটি স্তবকে বিভক্ত। প্রতি পঙক্তিতে থাকে আটটি দল।
এর মিলবিন্যাস রীতি
ক ক খ খ ক/ ক ক খ/ ক ক খ খ ক।


রঁদেলঃ
রঁদেল (rondel) ফরাসি কবিতার একটি পুরানো প্রকরণ। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক থেকে এটি প্রচলিত। পরবর্তীকালে ইংরেজি ও রোমানীয় ভাষায় এই প্রকরণ ব্যবহৃত হয়। প্রথম দিকে এর মিলবিন্যাস ছিল এ রকম : AB aA ab AB. বড় ছাঁদের অক্ষর দিয়ে পঙক্তির পুনরাবৃত্তি বোঝাচ্ছে। এর একটি বিন্যাসান্তর হল : ABBA abBA abba ABBA. সবচেয়ে বেশি যে বিন্যাসটি প্রচলিত সেটা হল : ABba abAB abba B/AB অর্থাৎ, শেষে একটি বা দুইটি পঙক্তি হতে পারে।
ইংরেজ কবিদের মধ্যে কয়েকজন এই প্রকরণে কবিতা লেখেন, তাদের মধ্যে রবার্ট লুই স্টিভেনসন (তিনি স্কটিশ ছিলেন) আমাদের কাছে বিশেষ পরিচিত 'ট্রেযার আইল্যান্ড'-এর রচয়িতা হিসাবে।
বাংলায় এই প্রকরণে চর্চার উদাহরণ পেশ করা হল।

বিফল সন্ধান তবু? নিসংবেদী মাটি ও আকাশ;
অলীক প্রতীতি শুধু, বিন্যাসের মায়াবী ছলনা;
তুমিও বুঝেছ তবু স্পষ্ট করে কখনো বলো না :
ভেবেছ হয়তো হবে অসম্ভব দিব্যের প্রকাশ।

এ-ভূমিমণ্ডলে নাই কল্পনার কোনো অবকাশ;
মূল্যহীন,যাতে কোনো কাঞ্চনের অর্জন হলো না;
বিফল সন্ধান তবু! নিসংবেদী মাটি ও আকাশ;
অলীক প্রতীতি, সবই বিন্যাসের মায়াবী ছলনা।

কখনো হবে না স্বচ্ছ কী বলেছে মাতাল বাতাস,
নদী বলে,'স্তব্ধ থাকো' কিংবা বলে 'চলো না, চলো না'
কখনো হবে না স্বচ্ছ। এ-সকল অসংখ্য তুলনা
যতই তোমাকে দিই, তবু নাও আশায় নিঃশ্বাস।

বিফল সন্ধান তবু। নিসংবেদী মাটি ও আকাশ;
অলীক প্রতীতি আর বিন্যাসের মায়াবী ছলনা...


সিংকুয়াইনঃ
সিংকুয়াইন (Cinquain) ছিল ইউরোপের মধ্যযুগের একটি কবিতা-প্রকরণ। পাঁচ পঙক্তিতে এর ব্যপ্তি। আদিতে এর ছন্দ ও মিলবিন্যাসে বিভিন্নতা ছিল। মার্কিন কবি Adelaide Crapsey এর একটি বিন্যাস নির্দিষ্ট করেন। এতে পাঁচটি পঙক্তিতে দল বা syllable এর বিন্যাস এমন : ২+৪+৬+৮+২
এককালের চর্চা থেকে উদাহরণ দিলাম।
“যখন
গিয়েছিলাম
খোলো নি দরোজা :
প্রবাহ কখনো ফেরে?
বৃথাই!”


গজলঃ
গজল আরব থেকে এর উৎপত্তি হলেও ফার্সি ভাষায় এটি বিশেষ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে উর্দু ভাষায় এটি সমধিক জনপ্রিয়তা পায়। আরবি, ফার্সি, পশতু, উর্দু ছাড়াও হিন্দি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, বাংলা এমনকি ইংরেজিতেও গজল লেখা হয়। প্রাথমিক দিকে ইমাম গাজালি, মওলানা জালালুদ্দিন রুমি, হাফিজ, সিরাজী, ফরিদুদ্দিন আত্তার, হাকিম শানাঈ প্রমুখ গজল লিখে বেশ নাম করেন। পরবর্তীতে আমির খসরু, মির তকি মির, ইবরাহিম জক, মির্জা গালিব, দাগ দেলবি এবং আধুনিক কালে আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ফিরাক গোরখপুরী গজল লেখক হিসাবে নাম করেন। গজল হালকা মেজাজের লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। আবার হালকা-গম্ভীর রসের মিশ্রণে সিক্ত আধ্যাত্মিক গান। গজল প্রেমিক-প্রেমিকার গান হলেও এ গান এমন একটি শৈলী যাতে প্রেম ও ভক্তির অপূর্ব মিলন ঘটেছে। পার্থিব প্রেমের পাশাপাশি গজল গানে আছে অপার্থিব প্রেম, যে প্রেমে স্রষ্টার প্রতি আত্মার আকুতি নিবেদিত। গজল গানে স্রষ্টা আর তার প্রেরিত মহাপুরুষদের প্রতি ভক্তির সঙ্গে মোক্ষ লাভের ইচ্ছা এসে মেলবন্ধন ঘটিয়েছে পার্থিব প্রেমের সঙ্গে।


মোতাকারিবঃ
আরবি ছন্দরীতি। "মুক্তদল–রুদ্ধদল-রুদ্ধদল” এই রীতিতে পর্ব বিন্যস্ত হয়।
যেমন-
"দোদুল দুল
দোদুল দুল।
বেণীর বাঁধ
আলগ ছাদ।“
--- নজরুল ইসলাম।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) সাহিত্যের রূপ -রীতি – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়
                    ২) ছন্দ – ড অমরেন্দ্র গণাই
                    ৩) ফেস বুক।
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করবেন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।