ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-৮, ভাগ-৭৬> – কবিতার নানান ধারা
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
-------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ – গীতিকাব্য
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি প্রবীর দে মহাশয়কে।          
------------------------------------------------------------------------------
গীতিকাব্য
বাংলা কবিতায় বাংলা গীতিকবিতার ধারা অন্যতম। গীতিকাব্য একজন কবির একান্ত ব্যক্তি-অনুভূতির সহজ, সাবলীল গতি ও ভঙ্গীমায় সঙ্গীত-মুখর জীবনের আত্মপ্রতিফলন। এটি গীতিকবিতা নামেই সাহিত্যামোদী ব্যক্তিবর্গের কাছে সমধিক পরিচিত। যে-কবিতায় কবির আত্মনুভূতি বা একান্ত ব্যক্তিগত বাসনা কামনা ও আনন্দ বেদনা তাঁর প্রাণের অন্তঃস্থল থেকে আবেগ কম্পিত সুরে অখণ্ড ভাবমূর্ত্তিতে আত্মপ্রকাশ করে, তাকেই গীতিকাব্য বা গীতিকবিতা বলে। এতে পরিপূর্ণ মানবজীবনের ইঙ্গিত নেই; এটি একক পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ থাকে। কবি এখানে আত্মবিমুগ্ধ, তাই সমস্ত কবিতাব্যাপী তাঁর প্রাণস্পন্দন অনুভব করা যায়। কবি তাঁর ব্যক্তি-অনুভূতি অথবা বিশিষ্ট মানসিকতা একে স্নিগ্ধকান্তি দান করেন। তাঁর চরিত্রের কমনীয়তা, নমনীয়তা বা দৃঢ়তা এতে প্রতিফলিত হয়।  সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।“ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, 'যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে একটিমাত্র ভাবের বিকাশ ঐ যেমন বিদ্যাপতি'র - ভরা বাদর মাহ ভাদর /শূন্য মন্দির মোর, -সে-ও আমাদের মনের বহুদিনের, অব্যক্ত ভাবের একটি কোনো সুযোগ আশ্রয় করিয়া ফুটিয়া ওঠা'।
আধুনিক বাংলা গীতি কবিতার পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল বৈষ্ণব কবিতার স্নিগ্ধ মাধুর্যে চিহ্নিত মধুসূদনের ব্রজাঙ্গনা কাব্যে। চতুর্দশপদী কবিতাবলীর সনেটেও কবির ব্যক্তি মানসের আবেগ বেদনার স্বাক্ষর ছিল। বিহারীলালের গোপনচারী কবিস্বভাব গীতিকাব্যের আত্মমগ্নতাকে যথার্থ রূপ দিল সারদামঙ্গল কাব্যে। গীতিকবিতার এই ধারার পূর্ণতা আসে রবীন্দ্রনাথে।
গীতিকাব্য অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বলে সাধারণতঃ দীর্ঘকায় হয় না। কারণ কোন অনুভূতিই দীর্ঘকাল স্থায়ী নয়। কিন্তু কোন কবি যদি গীতি কবিতায় তাঁর ব্যক্তি-অনুভূতিকে একান্ত আন্তরিকতার সাথে অনায়াসে দীর্ঘকারে বর্ণনা করতে পারেন, তবে তার মূল রস ক্ষুণ্ণ হয় না। কবির আন্তরিকতাই শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা বা গীতিকাব্যের একমাত্র কষ্টি-পাথর। ইংরেজি সাহিত্যে গীতিকাব্য 'লিরিক' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বীণাযন্ত্র সহযোগে এই শ্রেণির সঙ্গীত-কবিতা গীত হত বলে এটি 'লিরিক' বা গীতকবিতা নামে চিহ্নিত।
গীতিকবিতার মধ্যে আমরা আন্তরিকতাপূর্ণ অনুভূতি, অবয়বের স্বল্পতা, সঙ্গীত-মাধুর্য্ ও গতিস্বাচ্ছন্দ্য - এই কয়েকটি জিনিস প্রত্যাশা করি। বলাবাহুল্য যে, গীতিকবিতা গান না হলেও আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে যে গীতি-কবিতা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সুরের প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে।
মন্ময় ও তন্ময় দুই প্রকারের রচনাই গীতিকবিতা। শুধু কবির অভিজ্ঞতার স্বরূপভেদ এবং প্রকাশ পরিবেশনার গুণে, বুননির প্রভেদের জন্যই একই গোত্রের হয়ে রূপ ভিন্ন। মোট কথা, যে কবিতায় কবির আত্ম-অনুভূতি বা একান্ত ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা আর আনন্দ-বেদনা তার প্রাণের গভীর থেকে আবেগ কম্পিত সুরে সম্পূর্ণ ভাবমূর্তিকে আত্মপ্রকাশ করে তারই নাম গীতিকবিতা।
গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য হল, অবয়বের স্বল্পতা, সঙ্গীত মাধুর্য ও গতি স্বচ্ছন্দ। এ কথা সত্য যে, গীতিকবিতা গান নয়, তবে গীতিকবিতায় সুরের প্রাধান্য বিদ্যমান। অর্থাৎ কবিতাকে গীতিময় করে তোলার জন্য সুরের মাধ্যমে ভাবের প্রকাশ গীতিকবিতার নিদর্শন।


**সংযোজিত হবে।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) সাহিত্যের রূপ-রীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ– কুন্তল চট্টোপাধ্যায়
                    ২) উইকিপিডিয়া
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করবেন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।