ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-১০, ভাগ-৯৪> – কবিতায় বানান ও ব্যাকরণ  
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
-------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ – অন্ত্যমিল
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি শাহিন আলম সরকার মহাশয়কে।          
------------------------------------------------------------------------------
অন্ত্যমিল
অন্ত্যমিল ছড়া,গান ও কবিতার গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। অন্ত্যমিল কিন্ত ছন্দ নয়। অন্ত্যমিল হচ্ছে গান কবিতা বা ছড়ার চরণের প্রান্তমিল। ধ্বনিগত সাদৃশ্য। অন্ত্যমিল বা প্রান্তমিল ছড়া, কবিতা বা গানের বহিরাঙ্গের একটি বিশেষ সৌন্দর্য। অন্ত্যমিল প্রধান গান, ছড়া বা কবিতার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। এর পাঠক শ্রোতাও বেশি। আমাদের মন মননে স্থায়ী রেখাপাতে বেশি পারঙ্গম। ছড়া, কবিতা বা গান মনে রাখার ক্ষেত্রে অন্ত্যমিল বিশেষ ভূমিকা রাখে।
আমার স্মৃতিশক্তির বিশ্লেষণে অকপটে বলতে পারি, অন্ত্যমিলে রচিত কবিতা ছড়া আমাদের মগজে যতটুকু গেঁথে আছে- অন্ত্যমিলহীন লেখা তার কিয়দংশ মনে নেই। অন্ত্যমিল ছাড়া লেখা কবিতাগুলো অনেকটা গদ্যের মতো। গদ্য কী সহজে মনে রাখা যায়? আমি তো মনে করি গদ্য মনে রাখা খুব কঠিন একটি সাধনা। গদ্যের ভাব বা নির্যাসটা আমরা মনে রাখি, পুরো টেক্সটা নয়। অপরদিকে অন্ত্যমিলীয় ছড়া কবিতা বা গান আমরা সহজেই মনে রাখতে পারি। অন্ত্যমিলটাই যেন আমাদের স্মৃতিকে সজীব রাখে।।
চোখ বন্ধ করে স্মৃতির পাতা একটু হাতড়ে আসুন। দেখুন- সেই জন্মদিনের পোশাক পরা বয়সে আমরা যে সব মজাদার ঘুমপাড়ানিয়া ছড়া কবিতা শুনেছিলাম, তা আমাদের আজও মনে আছে, স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। যেমন-
ক। আমপাতা জোড়া জোড়া / মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া।
খ। খোকন খোকন ডাক পাড়ি / খোকন মোদের কার বাড়ি!
গ। আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে / ঢাক ঢোল ঝাঁজর বাজে।
ঘ। নষ্ট আশা নষ্ট স্বপন নষ্ট আমার চিত্ত
নষ্ট স্রোতে ভাসছে যেন শান্তি আনার বিত্ত।
ঙ। ভোর হল দোর খোল খুকুমনি ওঠোরে
ঐ ডাকে জুঁই শাখে ফুলখুকী ছোটরে।
নিশ্চয়ই এসব ছড়া কবিতার পরের চরণগুলো আপনাদের চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। সবারই মনে আছে। আরও কত কত ছড়া, কিশোর কবিতা আপনাদের মনে আছে তা লেখাঝোকা নেই। শুধু ছড়া বা কিশোর কবিতা কেন, অনেক আধুনিক ভাব সমৃদ্ধ, অলঙ্কার মণ্ডিত অন্ত্যমিলের কবিতাও আমাদের মনে আছে। যেমন-
ক। এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
            -জসীমউদ্দীন
খ। বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল
ঝাঁউশাখে যেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল।
             -বেগম সুফিয়া কামাল
গ। গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা
কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা।
            -কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঘ। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেলো যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দেবে কোন বলিদান?
ঙ। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
              -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আশাকরি অন্ত্যমিলের শক্তি ও সামর্থ্যটা এতোক্ষণে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি। এখন উদ্ধৃত চরণগুলোর শেষ শব্দ বা শেষ ধ্বনিগুলো একটু খেয়াল করা যাক। যেমন- প্রথম ধাপের অন্ত্যমিলসমূহ
জোড়া // ঘোড়া,
পাড়ি // বাড়ি
সাজে // বাজে
চিত্ত // বিত্ত
ওঠোরে // ছোটরে।
আবার ২য় ধাপে আমরা অন্ত্যমিল পেলাম-
তলে // জলে
কোল // দোল
বরষা // ভরসা
জয়গান // বলিদান
বাঁকে // থাকে।
দেখার ও মজার বিষয় হল-
ক। প্রথম ধাপের প্রথম চারটা অন্ত্যমিল একেবারেই ষোলো আনা। এজাতীয় অন্ত্যমিলকে সবল অন্ত্যমিল বলা হয়। সবল অন্ত্যমিল ধ্বনিতে ধ্বনিতে সাদৃশ্য বা সমতা থাকা।
খ। দ্বিতীয় ধাপের দু একটি অন্ত্যমিল কিন্তু ষোলো আনা হয়নি। যেমন-
জয়গান // বলিদান।
গ।কখনো কখনো একেবার হুবহু সমবর্ণের সমধ্বনির অন্ত্যমিল চোখে পড়ে। যেমন:
আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা // চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।
এখানে “দিয়ে যা” পরপর দুচরণেই ব্যবহার হয়েছে। যা কিছুটা দুর্বলতারই নামান্তর। দিয়ে যা দুবার না লিখে নিয়ে যা / পিয়ে যা লিখলে কিন্তু আরেক রকম সৌন্দর্য পেত।
ক) কার চিহ্ন ভিত্তিক হয়ে থাকে এবং এক অক্ষর বিশিষ্ট অন্ত্যমিল হলে শব্দের শেষ বর্ণের সমধ্বনি/একই বর্ণ এবং একই স্বরধ্বনি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন- গান+মান+পান+দান+তান+কান+টান
(এখানে শব্দের প্রথমাংশে ‘আ’ স্বরধ্বনি এসেছে এবং শেষ বর্ণটি সব জায়গায় ‘ন’ ব্যবহার হয়েছে।
খ) দু অক্ষর বা দু সিলেবল বিশিষ্ট অন্ত্যমিল হলে সেখানে প্রথম অক্ষরে সমস্বরধ্বনি এবং শেষ অক্ষরে সমস্বরধ্বনি ও সমবর্ণ ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন
বলা /কলা /চলা /গলা/ তলা/ খলা
ভোলা / পোলা/ তোলা/ নোলা/ গোলা
নানি/ জানি/ মানি/ পানি/ খানি/ আনি
হাসি/রাশি/ নাশি/ কাশি/ খাসি/ চাষী
জাগলো/রাগলো/ ভাগলো/মাগলো
গ ) তিন অক্ষর বা তিন সিলেবল বিশিষ্ট শব্দের অন্ত্যমিল:
তিন অক্ষর বা তিন সিলেবল বিশিষ্ট শব্দের অন্ত্যমিলে মনে রাখতে হবে শেষ দুটো ধ্বনি/ বর্ণ/ অক্ষর একেবারই সম/একই হতে হবে। যেমন-
থামানো/ ঘামানো/ নামানো
যামিনী/কামিনী/থামিনি/গামিনী/ঘামিনী
ঘ ) তিন বা চার অক্ষর/সিলেবল বিশিষ্টি শব্দের অন্ত্যমিলে একান্ত অপারগতায় ও অপরিহার্যতায় সমবর্ণ না পেলেও সমকার চিহ্ন সম্বলিত ধ্বনি ব্যবহার করতে হবে এবং ন্যূনতম শেষ বর্ণ/ শেষ ধ্বনিটা অবশ্যই সম(একই) হতে হবে। যেমন:
কারাগার/জাগাবার/ হাহাকার/পারাবার
নারায়ণ/ বাতায়ন/বনায়ন
ঙ) মাঝে মাঝে শেষ পর্বের একাধিক শব্দের সমম্বয়ে অন্ত্যমিল (ধ্বনির মিল বললে বেশি ভালো) হয়ে থাকে। যেমন:
তাল কেটে/ খাল কেটে /চাল ছেঁটে/ ডাল বেটে
চ ) কখনও কখনও সমার্থক শব্দ দিয়ে অন্ত্যমিল করা হয়ে থাকে। এজাতীয় অন্ত্যমিলীয় লেখাপড়ার সময় অর্থ উদ্ধারে বেগ পেতে না হলেও শ্রুতির সময় বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেকের পক্ষে অর্থ উদ্ধার সম্ভব হয় না। যেমন:
কূল/কুল, পার/পার, বান/বাণ, বিনা/বীণা,
নিচ/নীচ, আপন/আপণ, সবান্ধব/স্ববান্ধব
ছ)মনে রাখার বিষয় হচ্ছে: অন্ত্যমিলটা সাধারণত হয়ে থাকে প্রায় সমোচ্চারিত শব্দের /ধ্বনির প্রয়োগে।
সমোচ্চারিত শব্দের / ধ্বনির প্রয়োগে নয়। যেমন
অবদান/অবসান/অবধান/অপমান/বহমান/রহমান/ চলোমান/কলতান/কলগান
জ) কখনও কখনও চরণে শুধু নয়, পর্বে পর্বেও মিল দিতে দেখা যায় কবি ছড়াকার ও গীতিকারদের। অর্থাৎ প্রথম পর্বের শেষ ধ্বনির সাথে দ্বিতীয় পর্বের শেষ ধ্বনির মিল। যেমন-
আমরা চলি/ দুঃখ দলি/আলোর ঠিকানায়
পাষাণ তাপে/ অভিশাপে/ কালোর সীমানায়।
ঝ) অন্ত্যমিল দেবার সময় সাধারণত অল্পপ্রাণ ও মহাপ্রাণ ধ্বনি বা বর্ণকে খেয়াল রাখতে হবে। অর্থাৎ অল্পপ্রাণ+ অল্পপ্রাণ এবং মহাপ্রাণ+মহাপ্রাণ দিতে হবে। যেমন:
অল্পপ্রাণ> বুকে/ধুকে, বাঁকা/ আঁকা, নাচা/কাঁচা
মহাপ্রাণ> মুখে/রুখে, মাখা/রাখা,মাঝে/সাঁঝে
এভাবে ধ্বনিগত সমতার ভিত্তিতে অন্ত্যমিল দিয়ে আমরা আমাদের গান কবিতা বা ছড়া লিখতে পারি।
এবার বলব-সবল ও দুর্বল অন্ত্যমিল প্রসঙ্গে। সবল অন্ত্যমিল বলতে ধ্বনিগত শতভাগ মিল দ্বারা গঠিত অন্ত্যমিলকে বোঝায়। যেমন-
শুনি/গুণী/মুনি/রুনী/বুনী/খুনী/কুনি
আসা/আশা/ভাসা/ভাষা/ নাশা/চাষা।
অপরদিকে ধ্বনির সামান্য তারতম্য সহকারে বা অল্পপ্রাণের সাথে মহাপ্রাণ,মহাপ্রাণের সাথে অল্পপ্রাণ ধ্বনির সমন্বয়ে যে অন্ত্যমিল, সেটাই দুর্বল অন্ত্যমিল। যেমন:
বুকে/সুখে, নাচো/আছো, আঁকি/পাখি
বাড়ি/সারি, কেড়ে/ ঘেরে, মান/প্রাণ/ঘ্রাণ।


**সংযোজিত হবে।
***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) অন্ত্যমিল : আবু তাহের বেলাল
                    ২) ইন্টারনেট।
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করবেন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।