ছন্দ ও কবিতার পাঠ <পর্ব-৪, ভাগ-৩১> – ছন্দে আসর কবিদের কিছু কবিতা
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি শ. ম. শহীদ মহাশয়কে।        
------------------------------------------------------------------------------
আজ আমরা অপর ছন্দের বেশ কিছু কবিতা, যা এই আসরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি লিখেছেন তার কয়েকটি আলোচনার জন্য তুলে দিলাম। কবিতাগুলি পাঠ করার পর আমরা পরবর্তী ছন্দ নিয়ে আলোচনা করব।


১) কবিতাঃ  উদাসী পথিক
কবিঃ উত্তম চক্রবর্তী
প্রকাশিত তারিখঃ ১৪/১১/২০১৭


এঁকেবেঁকে চলে গাঁও মেঠোপথ গাঁয়ের বুকটি ছিঁড়ে,
পথিক চলেছে আপন মনেতে প্রিয়ার কাছেতে নীড়ে।
দুধারে তাহার সবুজ বনেতে গিয়েছে মনটি ভরে,
পথের ধূলোরা আপন করেছে পথিক সাথীকে ঘিরে।
সোনালী ধানের ঢেউয়ে খেলানো বাতাসী সুরের মেলা,
আকাশে নীলের সীমানা ছোঁয়ানো দোলানো পাখির খেলা।
পথকে ভালোবেসেছিল পথিক পড়েছে পথের প্রেমে,
ভুলিয়েছে পথ পথিকরে তাই ভালোবেসে তার প্রেমে।
উদাসী পথিক হারিয়ে ফেলেছে ঠিকানা তাহার তরে,
পথটি তাহার পথিক সাথীকে চিনিয়ে নিয়েছে পরে।
পথিকের প্রিয়া রয়েছে বসিয়া আসিবে কখন সাথী?
ভালোবেসে পথ নিয়েছে সাথীকে প্রিয়ার কাছেতে গাঁথি।


২) কবিতাঃ  তুমি যে আমার প্রাণ...
কবিঃ রীনা বিশ্বাস (হাসি)
প্রকাশিত তারিখঃ ৩১/১০/২০১৭


জগতের নাথ তুমি হে সখা
আমার আরাধ্য ধন
অবলা অখলা যা বল আমারে
সয় সবই মন।
বন্ধু, তুমি যে আমার প্রাণনাথ
হৃদয় নিংড়ে বলি
তোমার পরশে আদেশে অনুরাগে
কঠিন পথটা চলি।
অকূল আঁধার এই ভব পারাবার
কোথায় তার শেষ!
তুমি যদি থাকো সাথে সাথে, হবে
সব পরিতাপ নিঃশেষ।
দেশে সমাজে ভুলোকে দ্যুলোকে আর
আপন কাকে ভাবি!
তুমিই আমার দেবতা হে চির সখা
জীবন মরণ সবই।


৩) কবিতাঃ  নদী ও প্রেমিক
কবিঃ সুদীপ্ত বিশ্বাস
প্রকাশিত তারিখঃ ১২/১১/২০১৭


পাহাড়ের বুক চিরে ঝর্ণাটা নামে
অনেক না বলা কথা আছে নীলখামে।
ঝর্ণারা মিলেমিশে হয়ে যায় নদী
শুনবে নদীর গান, কান পাতো যদি।
ও নদী কোথায় যাও? ছলছল তানে?
দাও নদী দাও বলে, জীবনের মানে।
ঘন্টার ঠুনঠুন, আজানের সুর;
নদী জলে মিশে যায় সোনারোদ্দুর।
ছোটছোট ঢেউ তুলে নেচেনেচে যায়
সব মেয়ে তাই বুঝি নদী হতে চায়?
ও নদী চলেছ বয়ে, নদী তুমি কার?
প্রেমিকটা প্রাণপণ কাটছে সাঁতার।
সাঁতরে-সাঁতরে আরও কতদূর যাবে?
কতটা গভীরে গেলে তবে তল পাবে?
নদীটা যেই না গিয়ে সাগরেতে মেশে,  
প্রেমিক ঘুমিয়ে পড়ে  সঙ্গম  শেষে...


৪) কবিতাঃ  পরাগ গন্ধ কবিতা
কবিঃ সুদীপ তন্তুবায়
প্রকাশিত তারিখঃ ১২/১১/২০১৭


ফুল ফুটলেই -
কিছু ফুল ঝরে পড়ে উনুনের পাশে
ফুল ফুটলেই -
কিছু ফুল গাঁথা হয় সূঁচে ইতিহাসে
কিছু ফুল মা হয়
কিছু ফুল নির্দয়
কিছু ফুল হাসে - লাশে অভিলাষে
কিছু ফুল জমে রয় না জলোচ্ছ্বাসে
ছোট ফুলঘাসে
কিছু ফুল তসলিমা - ফোটে পরবাসে


৫) কবিতাঃ  নারী
কবিঃ  মল্লিকা রায়
প্রকাশিত তারিখঃ ২৫/০৪/২০১৮


এ বুকের মাঝে সিন্ধু গঙ্গা
যমুনার কোলাহল
হৃদয়ে বহেছে অহরহ স্রোত
পাহাড় বিন্ধ্যাচল।
আগুন দেহের অযোধ্যা পৃষ্ঠায়
কামরুপ আর
বানরপুরীর শিলালিপি
হয়ে যায়।
কৃষ্ণা কাবেরী দুধারে আমার
তার খরস্রোত আমি
বহতা আমার স্বভাবসুলভ
মেনেছে অন্তর্যামী।
বাহুতে জড়িত লতা আশ্বাস
মাধবীলতার ঘ্রাণ
নাভি আর পেটে বীর্য আধারে
পৌরুষ ম্রিয়ম্রান।
যোনী জঙ্ঘার নিষেক ভূমিতে
মঞ্জরি চরাচর
দু'পায়ে কামের দোসর জড়ানো
তার আমি সহচর।
চোখের ভ্রুর তপ্ত নাচনে
পৌরুষ ভাঙা গড়া
অধর প্লাবনে অথৈ কামনা
সহজাত বোঝাপড়া।
মাথায় বহেছে সপ্ত সাগর
পৃথিবীর পারাবার
দু' ঠোটের বাঁকে আগুন মিশেছে
নারীনাম জপিবার।


৬) কবিতাঃ  রহস্যময়ী  
কবিঃ  খলিলুর রহমান
প্রকাশিত তারিখঃ ১৭/৪/২০১৮


রাতের বাতাস সোহাগে নাচালো
হাজার গাছের ফুল
মেঘের সিঁড়িতে তারার বৃষ্টি!
নয়নের সে কী ভুল?
রেশমী তন্তু গায়েতে জড়ায়ে
সুগন্ধি পথে ফেলে
কে যায় নাচিয়ে বাতাসের প্রাণ
বাঁশিতে এ সুর ঢেলে?
পূর্ণিমা-চাঁদ ভাসালো জগত
মায়াবী আলোর বানে
আবেশে হারানো হৃদয় মগ্ন
কোকিলের কুহু তানে।
এমন নিশিতে মধুর হাসিতে
সোনারঙ আভরণে
কে মেয়ে হারালে মানুষের ভীড়ে?
আমি মরি শিহরণে।
খুঁজিতে তোমায় বারবার চায়
দেখি না কোথাও ভীড়ে
দেখা দিলে শুধু, ও সোনার মেয়ে
এলে না আমার নীড়ে।
বিষাদ নয়ন ফিরিয়ে যখন
শূন্য সে নীড়ে চাই
আবার হারানু তোমার হাসিতে
স্তিমিত-প্রদীপ-ছায়।


৭) কবিতাঃ  বরণ  
কবিঃ  রিঙ্কু রায়
প্রকাশিত তারিখঃ ১৮/১২/২০১৭


ওগো নিঠুর মরণ, তুমিযে শ্যামের গড়ন!
শত জ্বালার কায়া, করগো তুমি বরণ।
তুমিতো তাপ জুড়াও, তৃষিত বুক ভরাও,
শান্তির পথ খুঁজে,  চির মুক্তিতে জুড়াও।
বিজন পথ হেথা, পাইনে তব দেখা,
কতো কাল বাকি,  যাব ওপার একা।
বাতায়নে কাঁদে চাঁদ, পাতে মায়ার ফাঁদ!
হেলায় কাটি বাঁধন, ভাঙি ক্ষয়িত বাঁধ!
টিমটিম দীপ জ্বলে, উদার গগন তলে!
তপ্ত ঝটিকা হানে, হৃদয় দিয়েছি খুলে।
ঝরে স্মৃতির পাতা, যত্নে রাখি বৃথা,
হারায়না কোনো ক্রমে, পিছন নেয় হেথা।
এসোনা ভরাও মোরে, চাবনা পিছে ফিরে।
অঞ্জলি দেব পায়ে,দুখ কুসুমের ভিড়ে।
পরম তৃপ্তি মেলে, হৃদয় দিই তুলে,
সংশয় মুছে ফেলে, বরণ দীপ জ্বেলে।
বন্ধুর চলা পথ, পুরিলোনা মনোরথ।
নামে ব্যর্থ রাত, বাঁধা দৃঢ় শপথ।
ভাঙলো ঝরে সাধন, ক্ষয়িত দিন যাপন।
রোজ সরাই আঁধার, করো মোরে আপন।


৮) কবিতাঃ  শিশুতোষ ছড়া  
কবিঃ  কবীর হুমায়ূন
প্রকাশিত তারিখঃ ২৭/১/২০১৮


'ছড়া লিখো, ছড়া লিখো' বলে যায় ছড়াকার,
শব্দের ঘুর্ণিতে যায় নাকো ধরা তার।
বিদঘুঁটে কবিতায় কত কথা বলা যায়!
ছন্দের দ্বন্দ্বেতে নন্দেরা কলা খায়।
ভাবনার ছলনাতে ভেসে যায় ছন্দটা,
জোর করে হেসে যাই, কেটে যায় মন্দটা।
ছড়া নাকি শিশুদের শিশুগণই পড়বে,
বুড়ো শিশু ছড়াকার ছড়া শুধুই গড়বে।
বুড়ো হয়ে শিশু হওয়া নয় তো রে সোজা কাজ,
বয়সটা বেড়ে গিয়ে জীবনের বোঝা আজ।
শিশুদের কথাগুলো বুঝি না আর সহজে,
'ছড়া লিখো, ছড়া লিখো' কেনোবা তা' কহ যে?
মনটাকে শিশু করো- শিশুদের অন্তর,
জেনে নাও ছন্দ ও শব্দের মন্তর।
ছন্দের কৌশলে শব্দেরাই নাচবে,
শিশুতোষ ছড়াকার হয়ে তুমিই বাঁচবে।
আমি যে তা' পারি নাই, তোমরা তা করো তাই,
কবি তুমি শিশুতোষ ছড়া লেখা ধরো ভাই।


৯) কবিতাঃ  সত্যভাষী  
কবিঃ  সিমনচন্দন বৈরাগী
প্রকাশিত তারিখঃ ২১/১২/২০১৬


অমন করে বলেন কেন?
বললে হবে দোষ।
বললে কথা সোজা-সাপটা
করে উঠবে ফোঁস।
ধরবে জ্বালা শরীর-মনে
মুখোশ খুলে দিলে
বাঘের মত মারবে থাবা
পারলে খাবে গিলে।
না যদি বলি কোনো কিছুই
নীরব থাকি ভয়ে
কোন সুখেতে বাঁচব বলো
বিবেক দংশন সয়ে?
বলবো কথা চলবো সদা
সত্যের হাত ধরে
মরলে দেহ নাই কো ক্ষতি
প্রাণ যেন না মরে।


১০) কবিতাঃ  আপন ভোলা মাঝি
কবিঃ  ডা. প্রদীপকুমার রায়
প্রকাশিত তারিখঃ ১৫/১/২০১৮


চোখের কোণ কালিতে ভরা
আকাশ মেঘে ঢাকা,
পূর্ণিমা চাঁদ গেলো কোথা
খুঁজিয়া মরে একা।
নদীর ঘাটে বসিয়া মাঝি
তুলিয়া ধরে পাল,
আশা নিরাশায় দুলিয়া সে
হয় যে বেসামাল।
জমিয়াছিল পারানি যাহা
করিয়া তাহা ব্যয়,
আপন ভোলা মাঝিগো আহা
পাইবে যে কোথায়?
কর্ম জানে ধর্ম নাহি
অচল এই যুগে,
কেমনে মাঝি হইবে পার
জীবন নদী বাঁকে?
ধরিতে হইবে যে খোদাকে
চলিতে সৎ পথে,
তাঁহার রহমত পাইবে
যাইবে বেহেস্তে।


১১) কবিতাঃ  মহা ঔষধি
কবিঃ  বিশ্বজিৎ শাসমল
প্রকাশিত তারিখঃ ২২/১২/২০১৭


আজব উপায় বলে মনিরুল বৈদ্য
জ্বর হলে ভোরে গেলো গোবরের সিদ্ধ
ফড়িঙের ঘি নাও আঁচ পরে কালিয়ে
রোজ যদি খেতে পারো যাবে বাত পালিয়ে।
মূলোর ছালকে বেটে রোদে নাও ফেটিয়ে
কাঁচা লঙ্কার কুচো দাও বেশ ছিটিয়ে
খাওয়া পরে জলে গুলে খাও ভরা পেটেতে
চাও যদি একমাসে বিশ কেজি হটাতে।
ছাগলের শিঙে নাও মধু-নুন মাখিয়ে
চেটেপুটে সাফ করো দুই কান ঢাকিয়ে
নিমগোলা জল খেয়ে শুয়ে যাও পেল্লায়
চকচকে দাঁত পেতে এর কোনো জুড়ি নাই।।


১২) কবিতাঃ  অভিমান
কবিঃ সঞ্চয়িতা রায়
প্রকাশিত তারিখঃ ২৪/১১/২০১৭


এ তো তোমার অভিমান
এ তো নয় রাগ।
মাঝে মাঝে নয় তো ক্ষতি
যদি হয় অনুরাগ।
পরেছো ক্ষণিকের তরে আজ
এ সূক্ষ্ম আভরণ।
খুলে ফেলে ছুড়ে দাও
তুমি এই ক্ষণ।
জমাট বাঁধা কালবৈশাখীর
ঝড়ের কালো ছায়া।
মুখের নীলিমা গ্রাস করেছে
হারিয়েছে তাই কায়া।
দূর করো তারে তীব্র ঝঙ্কারে
বিজুলিরর আলোক ছটায়।
ঘোর তমসা দূর করে দাও
তারাদের ঘনঘটায়।
তোমার দুচোখে অশ্রু সজল
ফুটিয়ে তোলো হাসি।
তারই ফুয়ারায় তোমার সাথে
চলে যেতে চাই ভাসি।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) বাংলা কবিতার আসর    
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করুন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।