ছন্দ ও কবিতার পাঠ –<পর্ব-৫, ভাগ-৪১>  – ছন্দে আসর কবিদের আরও কিছু কবিতা
---ড. সুজিতকুমার বিশ্বাস  
------------------------------------------------------------------------------
আজকের পাঠ উৎসর্গ করা হল - আসরের প্রিয়কবি গোলাম রহমান মহাশয়কে।        
------------------------------------------------------------------------------
আজ ছন্দ শেখার জন্য আসর কবিদের আরও কিছু ছন্দের কবিতা তুলে দেওয়া হল।


১। কবিতাঃ  চাঁদ ভাসে জলে
কবিঃ গোলাম রহমান
প্রকাশিত তারিখঃ ২১/১১/২০১৭


দাঁড়ায়ে গিরিখাদের কিনারায়
দু’হাত বাড়াও চাঁদের নেশায়!
চাঁদ ভাসে জলে,
তুমি জলতলে;
কী লাভ চাঁদের পিছনে ছোটায়!


২। কবিতাঃ  একটি বাদল দিনে
কবিঃ মিলেটস
প্রকাশিত তারিখঃ ২৬/১০/২০১৭


ঝরে ঝরে পড়ে জল বসে আছি ঘরে,
কালো রেখা দেয় দেখা মেঘেদের স্তরে।
কিছু হাঁস কাদা জলে এক মনে খেলে।
অতীতের কত কথা মনে ছায়া ফেলে।
কিছু চাষী হাসি মুখে চারা নিয়ে যায়,
বরষার মৃদু জল আসে জানালায়।
ফাঁকা ঘর একা আমি আঁধারেতে ভরা,
বৃষ্টির নেশা লেগে হেসে উঠে ধরা।
কত কাজ আছে বাকি তবু আছি বসে,
কিছু স্মৃতি ফিরে ফিরে বারে বারে আসে।
আনমনে জানালায় চেয়ে থাকি দূরে,
কিছু গান বেজে উঠে বরষার সুরে।


৩। কবিতাঃ  স্বপ্ন আছে চেয়ে
কবিঃ শাহিন আলম সরকার
প্রকাশিত তারিখঃ ২২/১০/২০১৭


আজও হয় নি দেখা, ভালবাসি যারে।
কথা হয় নি যে ঘুমে, স্বপ্ন বিলি করে।
হাসি মুখ দেয় ফাঁসি, সারা নিশি ভরে।
ঘুম যেন নেয় কেড়ে, সারা নিশি ধরে।
সে যে আছে কত দূর, কত দেশ পরে।
তার কথা ভেবে ভেবে, মন যেন মরে।
স্বপ্ন যেন সত্যি হবে, কাছে পেলে তারে।
বধূ করে তারে যেন, নিতে পারি ঘরে।


বহু পথ পাড়ি দিয়ে, ছোট কোন গাঁয়ে;
গেছি কারো নিমন্ত্রণে, উপলক্ষ বিয়ে।
আঁকাবাঁকা চাপা পথ, বাঁশবন দিয়ে;
হেটে হেটে যেতে হয়, চারদিক চেয়ে।
মনে পড়ে এই পথ, আসে স্বপ্ন হয়ে।
কিছু দূরে বাড়ি মধ্যে, স্বপ্ন আছে চেয়ে।


৪। কবিতাঃ  গাছের ছায়ায় ঘেরা
কবিঃ লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
প্রকাশিত তারিখঃ ১১/১০/২০১৭


গাছের ছায়ায় ঘেরা ছোট মোর গ্রাম,
রাখাল বাজায় বাঁশি ভরে চিত্ত প্রাণ।
গাঁয়ের মাটিতে ফলে সোনার ফসল,
গাঁয়ের দিঘিতে ফোটে কুমুদ কমল।


গাঁয়ে আছে ছোটঘর ছোট ছোট পাখি,
প্রভাত সময়ে ওঠে কিচি মিচি ডাকি।
গাঁয়ের পথেতে রোজ চলে গোরুগাড়ি,
আম কাঁঠালের গাছ আছে সারি সারি।


অজয় নদীর ধারা, বয়ে চলে যায়,
তরী বেয়ে চলে মাঝি ভাটিয়ালি গায়।
নদী তটে আছে বসে ধবল বলাকা,
শঙ্খচিল চলে উড়ে মেলে দিয়ে পাখা।


গাছের ছায়ায় ঘেরা ছোট গ্রামখানি,
গাঁয়ের মাটিকে বড় ভালবাসি আমি।


৫। কবিতাঃ  চিত্রকর
কবিঃ গোপালচন্দ্র সরকার
প্রকাশিত তারিখঃ ১৫/১০/২০১৭


সৃজনশীল প্রখর ,        নিষ্ঠা যার অপার ,
            সে যে মহান চিত্রকর ;
চিত্রপট শূন্য-সাদা,     তুলিয়া তুলী সদা-
           কত আঁকে রূপে মনোহর !


চিত্ত যার একমনা,     কল্পনার মুক্ত ভাবনা ,
            পায়, নব সৃষ্টির প্রকাশ ;
মানসপটে স্মৃতি রাখি,   মসীসহ আঁকি-আঁকি ,
            নব কায়া হয় যে বিকাশ ৷


তপস্যা, ধ্যান, ভক্তি,     নাভাবা সুলভ খ্যাতি ,
             কর্মবেশ করিয়া ধারণ ;
প্রতি ক্ষণে-ক্ষণ,          অসীম নব চিন্তন ,
            গড়ে চিত্র মনের মতন ৷


প্রবাহমান ঘটনা ,         চিত্রপটে ভরে নানা ,
            কৌতুহলীত তার যে মন ;
সহায় সাথী, প্রেরণা-      উৎস, তার সাধনা
            তার সম্বল ভাবাবেগ রতন ৷


গভীর হতে গভীর,        রাখিয়া চিত্ত সুস্থির ,
             একাগ্র মনে করে জল্পনা ;
নিরাকাররে সাকার,      কতনা আকার প্রকার ,
             বিচিত্র সৃষ্টি তার যে কল্পনা ৷


শিল্প সাধক চিত্রকর -       ভাবনা যার উদার ,
             সৃষ্টিরে সে স্বীকারে প্রিয়বন্ধু ;
একাগ্রতায় শিল্প নিয়ে ,    অহরহ সময় ক্ষয়ে ,  
             রূপে গড়ে, বিন্দুরে সে ইন্দু !


৬। কবিতাঃ  ইচ্ছেপরী  
কবিঃ বৃষ্টি মন্ডল
প্রকাশিত তারিখঃ ০২/০৮/২০১৮  


ইচ্ছেরা হাসে ইচ্ছেরা ভাসে...
ডানা মেলে উড়ে যায় অলীক আকাশে।
এ যেন ইচ্ছেপরী  নদী বইছে অতি
পারিজাত কুসুম দোলায় মতি ।
কত রাত আসে গভীর বাতায়নে
কি যেন বলে যায় কানে কানে।
কত যে হাসি-ব্যেথার মাঝে আছে লুকিয়ে ইচ্ছেপরী তাই অচীন দেশে যায় হারিয়ে ।
একটি মনের ইচ্ছে অনেক যত স্বপ্ন আবেশ
মেঘ-আলো-ছায়া ঝাপসা-কুয়াশা মনে প্রশ্ন অশেষ ।
বেখেয়ালি মনে ভাবনা যত আঁকে
রামধনু রঙ মাখে চোরা গলির বাকে
আজকে হাওয়ায় ইচ্ছেপরী  মেলেছ ডানা
কাল কী হবে তা নাইকো জানা.......
ছন্নছাড়া ইচ্ছেপরীর  নেই কো তুলনা
মন পাখি খুঁজে ফেরে ভালোবাসার ঠিকানা।
ইচ্ছেরা হাসে ইচ্ছেরা কাঁদে ইচ্ছেরা ভাসে
ইচ্ছেপরী বেপরোয়া হয়ে ধেয়ে আসে ......।


৭। কবিতাঃ  একান্তে আপন-২
কবিঃ সঞ্জয় কর্মকার  
প্রকাশিত তারিখঃ ২৬/০৭/২০১৮  


রিম ঝিম বহে ধারা অনন্ত বর্ষণে
মাঠ ঘাট জলময় প্রশান্ত দর্শনে,
মনলোভা ভরা গাঙে কূল ভরা জল
উছলেতে বহে নদী শত তার বল।
মাছরাঙা পাখি গুলি ডানা মেলে ধায়
কবি তার কবিতায় কলি লিখে যায়।
গুরু গুরু গরজনে নাহি থামে ধারা
মাতোয়ারা অজয়েতে আজি জলে ভরা।


বানভাসি শত প্রাণে কান্নার রোলেতে
ঘরবার ভাসিবার দুঃখের দোলেতে।
উঁচু পাড়ে বাসা বাঁধে ত্রিপলেতে গড়া
চারিধার জলময় ক্ষুদা প্রাণ হরা।
পথ পানে চেয়ে থাকে শূন্য আনমন
ক্ষুদা তার নিরসনে-“একান্তে আপন”।


৮। কবিতাঃ  সুবচন
কবিঃ মিনু গরেট্টী কোড়াইয়া (বৃষ্টিরানী)
প্রকাশিত তারিখঃ ১৯/০৭/২০১৮


নির্দয়-দুর্বাক্য তোমার শব্দ বচনে
অবাধে বিক্ষিপ্ত করে মানব অন্তর
কিরূপ ধরো তুমি ঐ কটাক্ষ নয়নে
ভয়ে থেমে যায় প্রবাহ, গতি মন্থর।।
শোনো, ঝরে বৃষ্টির রিমঝিম কাননে
প্রাঞ্জল নহলী পল্লব, মাঠ-প্রান্তর
অলিরা বেড়ায় সুখে মধুর গুঞ্জনে
তেমনি সুশ্রাব্য থাক্ মুখে নিরন্তর;


কাব্যের স্তরে স্তরে থাকুক মধুসুধা
সুর মাধুর্যে ধরায় হোক বরিষণ
ঘুচাবে হৃদয়ে অতৃপ্তি, মিটাবে ক্ষুধা
তেমনি সত্য বাণী ছড়াও অনুক্ষণ;
সুশ্রাব্য ঝরুক মুখে, বাঁচুক বসুধা ।
ঘুচুক ক্লেশ, নিভে যাক তীক্ত দহন।


৯। কবিতাঃ  উড়ো মেঘ
কবিঃ মনোজ ভৌমিক  
প্রকাশিত তারিখঃ ২৭/০৬/২০১৮


কোথা হতে আসো তুমি,কোথা চলে যাও!
ক্ষণেক কাঁদিয়া নিজ,সবারে হাসাও।
বাতাসের সাথে ভাসি যাও তুমি কোথা!
কাহারে শোনাও অশ্রুসিক্ত ব্যথা কথা?
পাগল পরাণ আজ খুঁজিছে কাঁদিয়া,
গাহে না জীবনের গান অতৃপ্ত হিয়া।
তৃষিত মাটির বুকে জাগে না'কো প্রাণ,
এ প্রাণে আসবে কবে সজীব আঘ্রাণ?


নদীর বুকেতে কাঁদে পিয়াসী স্পন্দন,
পাহাড় হৃদয়ে ঝর্ণা নাচিবে কখন?
কেন তুমি যাও চলি বলো নাগো প্রিয়ে?
প্রতিধ্বনি শুনি সদা হাহাকার নিয়ে।
যক্ষের বিরহ নিয়ে কাঁদে সসাগরা,
তোমার স্নিগ্ধ পরশ পায় না তো ধরা।


১০। কবিতাঃ  কবি ড. সুজিত বিশ্বাস
কবিঃ অনিরুদ্ধ বুলবুল
প্রকাশিত তারিখঃ ২৫/০৫/২০১৮ (আসরের কবি-২ এ মন্তব্য)


ওরেব্বাস্ কবি! একি হুলস্থুল!
কবি ধরে কাব্য লিখে ফেলেছেন কী শোরগোল!
কৃতার্থ হলাম জেনে এ-কবিতা মূলে
অধমও আছি তাঁর সুচয়িত ফুলে!


কবিতার বুলি যার নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাস
নাড়ি টেপা ডাক্তার না; কবি সুজিত বিশ্বাস
ধার আছে লেখনীতে - কী ছন্দ কিবা সনেটে
একেএকে, কবিদের তুলে আনে পাতা পাতা হেঁটে।


নিটোল কাব্যের ধারা আর বিধি-কানুন
কায়মনে শিখিয়ে যান, সে এক মস্ত গুণ।
ভুলভাল ছন্দে লিখেছি এই কবিতাখানি
জানি, মাত্রাগোনে ভুলগুলোও ঠিক করবেন তিনি।


১১। কবিতাঃ  কাটা গেছে হাত
কবিঃ গৌরাঙ্গসুন্দর পাত্র
প্রকাশিত তারিখঃ ২২/০৫/২০১৮


কবে যেন কাটা গেছে হাত
হৃদয়ের বহু কাছে থেকে
তখন বুঝিনি ।
যে প্রেম গিয়েছে চলে
সে তো যাবে বলে এসেছিল
চলে গেছে যাক,
শুধু বুকের মাঝে থাক
সেদিনের আরক্ত নয়ন  ।
যে ব্যথা রয়েছে জেগে
তার স্পর্শে দেখি আজও
দিনান্তের করুণ গগন ।


যে গিয়েছে সেতো এক মায়াবী কাজল
দুটি চোখে এঁকে দিতে চেয়েছিল
জীবনের যত আছে ছল ।


১২। কবিতাঃ  কুয়াশাশর্বরী
কবিঃ শিমুল শুভ্র
প্রকাশিত তারিখঃ ৯/১/২০১৮


ভোরের আলোয় শীতের মেঘে, শিশিরেরা করছে লুকোচুরি,
দূর্বা ঘাসে শিশির ভেঙে ওরে  কে যায় আঁচলে চকচকে জরি।
পায়ে নূপুরের আওয়াজ , খেয়ালস্রোতে গেয়ে যাচ্ছে গুনগুণ ,
আমি অপলক দেখি, বারবার দেখি যেন কুয়াশাশর্বরী রুনঝুন।


সূর্যি মামা কুয়াশাভেদে প্রদীপ জ্বেলেছে ,পুরো পৃথিবীর  ঘরে,
আমার ছন্দোময় মন হিল্লোল খেলে, তার নীলাঞ্চলে রূপের ছলে।
তার কানের দুল যেন শাপলা শালুক,  শিথিল চোখের পলক,
সে যে একবার চেয়ে বারবার চেয়েছে, বিস্মিত রূপের ঝলক।


যেই শূন্য মনে এতদিন ছিলো, আধ-জাগা আধ-ঘুমো অলস দিন,
এই প্রভাতে যেন তাকে দেখে ভাগ্যে দিলেম চুমো জীবনটা রঙ্গিন।
যেই স্বপন ছিলো এই বুকের মাঝে, মনের কোণে বীণার সুরের তার,
এমন কেউ আসবে, কুয়াশাশর্বরী  হয়ে গলায় পড়াবো ফুলের হার।


উদয়রবির আলোর আড়ালে , আমি আবার তাঁকে খুঁজে চললাম,
যেই হারিয়েছে কুয়াশার ভিড়ে, শিশিরের স্রোতে মন ভরে ডাকলাম,
সেই দিন পাইনি তারে  চোখের ঘরে, জীবনপ্রবাহের  খেয়াঘাটে,
আজো পথচেয়ে  আছি ,সেই কুয়াশাশর্বরী'র যদি ধরা দেয় মনপটে।
  
*গত ১২/১০/২০১৮ তারিখে ছন্দ ও কবিতার পাঠ –২১  এ এই আসরের ১২ জন কবির কবিতা ও ১০/১২/২০১৮ তারিখে ছন্দ ও কবিতার পাঠ –৩১ এ এই আসরের অপর ১২ জন কবির কবিতা  এবং আজ এই আসরের  আরও ১২ জন কবির কবিতা সঙ্কলিত করে দেওয়া হল শুধুমাত্র ছন্দ শেখার স্বার্থে। একজন কবির কবিতা একবার মাত্র দেখানো হয়েছে। অনেকে নানা ছন্দেই সাবলীল। কিন্তু এখানে একজন কবির উদাহরণ বারবার আনা হয় নি।


***আজ এই পর্যন্ত। তবে চলবে।
------------------------------------------------------------------------------
সূত্র/ ঋণস্বীকার- ১) বাংলা কবিতার আসর    
----------------------------------------------------------------------------
আসরের কবিদের কাছে আমার অনুরোধঃ এই আলোচিত পর্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে নীচে সযত্নে উল্লেখ করুন। তাছাড়া কোনো গঠনমূলক মতামত থাকলে আন্তরিকভাবে জানাবেন।