এইসব মহাপুরুষগন জীবনের বিভিন্ন দিককে ভাস্বর করিয়ে গিয়াছেন নিজ নিজ বৈশিস্ট্যে। এরূপ দৃষ্টিকোনে মাইকেল মধুসুদন দত্ত-কে কখনই স্যামুয়েল কোলারিজ-এর সঙ্গে লীন করিয়া দেখা যায় না। আবার ভিন্ন দৃষ্টিকোন হইতে দেখিলে দেখা যায় বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন ভাবে যে সকল মহাপুরুষেরা জন্মগ্রহণ করিয়াছেন এবং তাহাদের অমূল্য হীরকখণ্ডরাজিরুপ চিন্তাতরঙ্গ বহিয়া দিয়া গিয়াছেন তাহা একই সুত্রে গ্রথিত। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্য হইতে আলাদা করা যায়না।‘Great Men Think Alike’ (‘মহাপুরুষেরা একই ভাবে চিন্তা করেন’) এই সুপ্রাচীন সুরটি এই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে বিশ্বসাহিত্যরুপ সমুদ্রের সহিত বাংলাসাহিত্যরুপ ভাগিরথী লীন হইয়া গিয়াছে। বিশ্বে যত মহাপুরুষ তথা কবি, লেখক, দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার প্রভৃতিরা তাঁহাদের লেখনি গৌরবশালী সম্পদে রূপান্তরিত করিয়া গিয়াছেন তাহাদের মধ্যে একটি সুরই বার বার ধ্বনিত হয় ‘মহাপুরুষেরা একই ভাবে চিন্তা করেন’। পুর্বোক্ত অকালপক্কগন আবার মাথা তুলিতে পারে – প্রমান চাই! অথচ তাঁহারাই যদি একটু বিশ্লেষণী ক্ষমতা সাহায্য লইয়া বিশ্বসাহিত্যের পৃষ্ঠা উল্টাইতে ব্রতী হয়, দেখা যাইবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহারই মূলভাব একই ভাবে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে শেলি, কিটস, বায়রনের লেখনিতে। প্রমান স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’ কিংবা নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ কি শেলির ‘Song to the man of England’ অথবা টমাস হার্ডির ‘Three Wayfarers’এর মধ্যে নিভৃত প্রতিরুপ গ্রহণ করে নাই? অথবা রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ‘ফটিক’ বা ডাকঘর গল্পের ‘অমল’ কি বিভূতিভুষন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালির ‘অপু’, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের ‘শ্রীকান্ত’, রমারোলার জাঁ ক্রিস্তফ-এর ‘ক্রিস্তফ’ কিংবা ওয়ার্ডস ওয়ার্থ-এর ‘লুসি’ নয়? এঁরা প্রত্যেকেই কি দূরদেশের রহস্যময় অবগুণ্ঠনের আহ্বান, আনন্দের আমন্ত্রণের সহিত সঙ্গলাভের জন্যে নিজ নিজ সৃষ্ট চরিত্রের মধ্য দিয়া এক অনবদ্য আকুতিমুরতি পরিগ্রহ করেন নাই? এদের প্রত্যেকেরই চরিত্রের, মানসিকতার, অনুভবের বিকাশ ঘটাইয়াছে প্রকৃতি স্বয়ং।