আহা! পদ্মা। মনে মনে বললাম – আহা কি দেখিলাম, কি হেরিলাম! চকিতে মনে পড়ে গেল মানিকবাবুর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। পদ্মা নদী  মূলত গঙ্গার নিম্ন স্রোতধারার নাম, আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায় গোয়ালন্দ ঘাটে গঙ্গা ও যমুনার সঙ্গম স্থলের পরবর্তী মিলিত প্রবাহই পদ্মা নামে অভিহিত। কিন্তু এ তো গেল তথ্যের কচকচি। আদতে চোখে যা দেখলাম, তার তুলনা কি? মন দিয়ে বয়ে গেল শান্তির স্রোতধারা। নিচু হয়ে দু-আঁজলা জল তুলে নিলাম, মাখলাম চোখেমুখে। আর এইভাবে এক হয়ে গেল আমার মননে গঙ্গা-পদ্মা। যারা সরকার মুনীরকে প্রসিদ্ধ কবি হিসেবে চেনেন, তারা হয়ত অনেকেই জানেন না, তার গানের গলাটি কি খাসা। পদ্মার জলের পাশে দাঁড়িয়ে তার উদাত্ত সুরেলা গলায় গান – মনে হচ্ছিল এভাবেই কেটে যাক না আরো কিছু কাল। কিন্তু সময় বড় দায়। আসলে বাংলাদেশের জন্য ৫/৬ দিন কিছুই না, নস্যি। উপরে উঠে এলাম। চা-ধুম-পান চলল, কেউ কেউ সামান্য পেটপূজাও করে নিল, বিশেষ করে মুনীর ভাই। বেচারা আমাদের খপ্পরে পরে উপবাসেই না দিন কাটে! এদিকে আমাদের গপ্পো তো চলছেই চলছে। থামার বিরাম নেই, কারণও নেই। এরপরের অভিযান পদ্মাঘাট। পদ্মাঘাটে এসে দেখলাম এলাহি ব্যাপার। অনেকেই লাইন দিয়ে টিকিট কেটে বোটে উঠে চলে যাচ্ছে ওপারে। আর ওপারেই ফরিদপুর। সুমিতার মনটা কেমন করে উঠল। আসলে আমার পুর্বপুরুষদের বাসস্থান দেখা হল, ওরটা হল না। সময়ে কুলিয়ে ওঠা গেলো না। বললাম না ৫/৬ দিনে কিছুই দেখা হয়ে ওঠে না, যতই রাত্রিদিন দৌড়াদৌড়ি কর না কেন। যাই হোক আবারও একবার সুদুরপ্রসারী দূরদিকচক্রবালে হারাতে চাওয়া পদ্মা মা’কে দেখে নিলাম দুচোখ ভরে। আমি তো সেই থেকে দু-চোখ ভরে পদ্মাকেই দেখে যাচ্ছি। কিন্তু পেট চনচন করে উঠতেই বুঝলাম এবার দুপুরের খাবার পালা। ঘাটের পাশেই সারি সারি মাঝিমাল্লাদের হোটেল। আমরা এগুলোকে বলি লাইনের হোটেল বা পাইস হোটেল।  জীবনে কোনদিন খাইনি এমন জায়গায়, তবু তাতেই চলবে। আমি গরম গরম ধোঁয়া ওঠা অনেকটা ভাত টাটকা পদ্মার ইলিশ দিয়েই সাবড়ে দিলাম। সুমিতা ইলিশ তো খেলই, সাথে চেটেপুটে খেল কালো জিরার ভর্তা,  ইলিশ মাছের ডিমভাজা, শুকনো লঙ্কা ভাজা, মায় আচারটাও বাদ দিলো না। ওর চোখে মুখে পরিতৃপ্তি ঝরে ঝরে পড়ছিল স্পষ্ট। ওর সাথে সাথে জুতসই সঙ্গত করলেন হুমায়ূন ভাই, মাসুম ভাই আর মুনীর ভাই। তবে ঈশানী এসবের কিছুই খেতে পারলো না। ওর শরীরটা একটু খারাপ হয়েছিল। তাই ওকে শুধু আঙুর জলে ভিজিয়ে দেওয়া হল। আমি এমনিতে মৎসপ্রেমী নই। তবে জিভে লেগে থাকা এই ইলিশের স্বাদ ভুলতে হলে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হবে এটা হলফ করে বলে দিলাম। আহার শেষ হল। শুরু হল সিগারেট সহযোগে হুমায়ূন ভাইয়ের ছন্দের ক্লাশ। উনি বেশ নিপুন দক্ষতার সাথে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, ছন্দবৃত্ত শেখাতে লাগলেন, একেবারে তার নিজস্ব ট্যাবলেটের পাতায় কবিতা খুলে খুলে। অনেক আগের শেখা, ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম। আবারো শিখলাম, শেখার কি আর শেষ আছে, না বয়স আছে।  


এবার পুরানো ঢাকা। অথবা কথ্য ভাষায় পুরান ঢাকা। সেখানে নাকি একটি দর্শনীয় বস্তু আছে – লালবাগ কেল্লা। হায় রে! কি কপাল করে ইচ্ছে জেগেছিল! কেল্লা একেবারে কেল্লাফতেহ করে ছাড়ল। পুরান ঢাকার সাথে একমাত্র বারাণসীর গলির তুলনাই চলে। একে আমাদের প্রকান্ড গাড়ি, তায় পুরান ঢাকার সরু সরু রাস্তা। ফলে শেষমেশ ফলাফল যা দাঁড়ালো – ৩ ঘণ্টা নষ্ট। তাও বা একরকম হল, শেষে অকুস্থলে পৌঁছে দেখি কেল্লার ফটক বন্ধ। কেন? কেন না আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী আর ছুটির দিন। তাই কেল্লা বন্ধ। আমরা হতবাক! বোঝো ব্যাপার! ছুটির দিনেই তো মানুষে এই সব দর্শনীয় জায়গা দেখতে যাবে। কি আর করা। অটো, লোকের ভিড়, আমাদের পেল্লায় গাড়ি, অজস্র রিক্সা, অপরিসর রাস্তা – এই সব ধ্বস্তাধ্বস্তির সময়কাল পেরিয়ে যখন শহীদ মিনারে পৌঁছলাম, তখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দরজায় কড়া নাড়ছে। হায় রে! ৩ ঘণ্টা বৃথা চলে গেল। এ হাহুতাশ রাখি কোথায়!


যাইহোক, দেখলাম শহীদ মিনার। আগেই একবার দেখেছিলাম কিন্তু সে তো রাতে। এখন গোধূলীর আলোয় বড় মায়াময় লাগছিল। পুলিশ ঘিরে ছিল পুরো শহীদ মিনার চত্বরটাই। স্বাভাবিক। বড় পুন্যস্থান এটি। চারদিকে তাকিয়ে দেখছি। কোথা কোথা থেকে লোক সমাগম হচ্ছে। সেই ভোররাত থেকে লোকের ঢল নেমেছে এখনো তার বিরাম নেই। অবাক মানলাম আমি। তুলনা করতে নেই, তবু নিমেষে আমাদের কলকাতার শহীদমিনারটি মনে পড়ল। এখানে দেখতে পাচ্ছি রংচঙে পোশাক পড়ে যুবক, যুবতী, শিশু, বুড়ো সবাই মেতেছে। কেউ গান গাইছে দল বেঁধে, কেউ হাসছে, কেউ ছবি তুলছে, কেউ টুকটাক মুখে চালান করে দিচ্ছে, কেউ আবার এক নিরাপদ কোন বেছে নিয়ে প্রেমটি সেরে নিচ্ছে গোধূলীকে সাক্ষী রেখে। জাতীয় উন্মাদনা কাকে বলে! এইসব দেখছি, হঠাৎ ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। মাসুম ভাই, সুমিতারা কোথায় ছিটকে চলে গেল। হুমায়ূন ভাইকে দেখতে পাচ্ছিলাম লম্বা মানুষ বলে। আমাকে ইশারা করছেন – চলে আসুন। আসব কি? আগে তো ঠেলা সামলাই। এদিকে পুলিশও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমি পিছন পানে দেখলাম একটা উঁচু জায়গা আছে। মুহুর্তে সেটার উপর দাঁড়িয়ে আমার ফোনের ক্যামেরার ভিডিও মোড চালু করলাম। তাতে নিমেষের মধ্যে এক ভারি দুঃখজনক চলচ্চিত্র ধরা পরতে লাগল। দলে দলে মানুষ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে ছুটছেন মুল শহীদ স্তম্ভের দিকে, তাও পায়ে জুতা পরা অবস্থায়!! বেশীর ভাগ ছেলেমেয়ে স্তম্ভের কাছে গিয়ে ছবি তুলছেন, অনেকে আবার সেলফি। এটা আমার উচিৎ মনে হল না। কারন উন্মাদনা ভালো, তবে তা যেন অসম্মানের ভাগীদার না হয়। একটু দুঃখ হল। যাইহোক ধাক্কাধাক্কির প্রাথমিক স্তরটা কেটে গেলে খুঁজে নিলাম মাসুমভাই, ঈশানী, মুনীরভাইদের। আমার মানসিক দিকটা একটু ধাক্কা খেয়েছিল বলে ফিরে চললাম গাড়ির দিকে। আবার আমার কবিবন্ধুদের থেকে বিদায়। হোটেলে ফিরে সব মালপত্র তুলে এবার রওনা বনানী। না। মাসুমভাইয়ের বাড়ি নয়। সেখানে কাল যাবো। আজ যার বাড়ি রাতের আতিথ্য গ্রহণ করতে যাচ্ছি, ভদ্রমহিলার নাম লায়লা খন্দকার শর্মী।


কে এই লায়লা খন্দকার শর্মী? ইনি আমার স্ত্রীর পেনফ্রেন্ড, যদিও একে অন্যের মুখ দেখেনি ২৪ বছর। অথচ যোগাযোগ ছিল এতদিন ধরেও। প্রথমে চিঠিপত্রে, তারপর ফেসবুক নামক সামাজিক মাধ্যমে। এই লায়লা খন্দকার শর্মী আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আজকের রাত্রের আহারটা তার বাড়িতেই সারবার জন্য। বাড়ি ঢোকার আগে সুমিতার মুখ থেকে একটু জেনে নিলাম এই লায়লা খন্দকার শর্মীকে। ইনি রোডস স্কলারশিপ পাওয়া মানুষ। আজকের দিনে রাস্তায় পড়ে থাকা অনাথ বাচ্চাদের (street-side child) এবং দুস্থ শিশুদের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের হয়ে। বনানীর মত অভিজাত এলাকায় মাসিক ১.৫ লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকেন ১১নং রাস্তায়, ব্লক-জি তে। এই বনানী এলাকাটা এতটাই অভিজাত এলাকা যে ঢোকার মুখেই ঘোষণা দেখলাম – এই এলাকা ভিখারিমুক্ত। যাই হোক, গৃহে প্রবেশের সাথে সাথে পেলাম উষ্ণ অভ্যর্থনা। অত বিশাল শিক্ষিতা কিন্তু ব্যবহার? একদম অমায়িক, মাটির কাছাকাছি, যদিও মোটেই আমাদের মতো হ্যা-হ্যা হাসির মানুষ নন। আভিজাত্যে মোড়া পরিমিত ব্যবহার। দারুণভাবেই সাজানো ফ্ল্যাট। বিশেষ করে কাঁচে ঘেরা ছাদ ছোঁয়া বইয়ের তাকটি আমার বেশ লাগল। কেননা আমার নিজের বাড়িতেও ছাদ ছোঁয়া বইয়ের তাক আছে, তবে কিনা অতটা অভিজাত মাপের নয়। অনেক গল্প হল। ২৪ বছর পর প্রথমবার একে অন্যেকে দেখা, দুজনেই অভিভূত। এত বছরের জমা কথা, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলে! আমি আর আমার মেয়েও তাতে যোগ দিলাম। ভদ্রমহিলার পান্ডিত্য অথচ বিনম্রতা এবং অতিথিবৎসলতার পরিচয় পেলাম অনেকটাই। রাতে স্বয়ং-সেবা (কিছুতেই self service-এর বাংলা পরিশব্দ ভেবে বার করতে পারলাম না) পদ্ধতিতে খাবার নেওয়া হল। অনেক পদের মধ্যে ইলিশ ছিল অবশ্যই। বাঙালীমাত্রই বোধহয় মাছের ব্যাপারে দুর্বল আর কে না জানে ইলিশ মাছের রানী। আসরের প্রিয় কবি মিতা চট্টোপাধ্যায়ের ‘মৎস্যগন্ধে মাতোয়ারা’ কবিতাটা মনে পড়ল। আমরা, মানে এপার বাংলার মানুষেরা, পদ্মার ইলিশ বলতে লালায়িত হই আর আমাদের পদ্মার ইলিশ নাম দিয়ে যেগুলো চালান করা হয় তার বেশীর ভাগই মায়ানমারের। আর ঢাকায় এসে তো অহরহ খাচ্ছি পদ্মার ইলিশ। সত্যি বলতে কি স্বাদটাই আলাদা। না জিভে দিলে বিশ্বাসই হবে না। তো এই লায়লা খন্দকার শর্মী আমাদের সেই সব ইলিশসমৃদ্ধ খাবার খাইয়ে পরিতৃপ্ত করলেন। বেশ ছিমছাম ডিনার শেষে এবার বিদায় নেবার পালা। আপাতত বিদায় জানালাম শর্মী ম্যাডামকে, তার সাথে বনানিকে। অবশ্য কাল আবার আসব। এবার মাসুমভাইয়ের অফিস। চারচাকায় চেপে উড়ে চললাম রাতের ঢাকা শহরের ঝকঝকে রাস্তা পেরিয়ে উত্তরার দিকে। আজকের রাতের মত ঘুমটাই বাকি।