পাঠকনামার আজকের পর্বে যে কবির কথা আজ বলবো তার কবিতার সাথে আমার আলাপ আজ থেকে বছর সাতেক আগে। কবি বহুদিন ধরে কবিতার ভুবনে বিচরণ করছেন। কিন্তু আমার হাতে এতো দিন পর কবির কবিতার বই আসা তে আমি নিজের প্রতি খুব হতাশ হয়ে ছিলাম,এমন এক কবি কে কেনো আমার পাঠ করা হয় নি! কবিতা গুলো পড়তে পড়তে বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে যেতে শুরু করলাম। আর তার পর থেকে আমার প্রিয় কবিদের তালিকায় উজ্জ্বল নক্ষত্রের স্থান নিলেন কবি শ্যামলকান্তি দাশ।


জন্ম: ১৯৫১ সালে; অবিভক্ত মেদেনিপুর জেলাতে। সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করতে পারেননি। জীবিকা হিসাবে বেঁচে নিয়ে ছিলেন সাংবাদিকতা; সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন। কবির বর্তমান ঠিকানা কোলকাতা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ কাগজকুচি। প্রচুর কাব্যগ্রন্থ, অনেক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, তার লেখা কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
অনেক পুরস্কার পেয়েছেন কবি , তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার , ইত্যাদি।


https://www.facebook.com/shyamalkanti.das.92 (কবির ফেসবুক পাতা)


কবির কবিতা গুলো পড়তে পড়তে মনে হয় বহু রঙের স্বাদের কবিতা, যেন কোন ফুলের বাগানে দাড়িয়ে। প্রতিটি কবিতা যেমন এক একটি ফুল, নিজস্ব নির্মাণ নিয়ে উজ্জ্বল তেমনি কবিতা গুলো অনেক গভীর ও বৈচিত্র্যময়। প্রতিটি লেখা বেগময় অথচ নিজস্ব ভাব ও আঙ্গিকে, নিরমানের দক্ষতায় কখন যেন পাঠকের পাঁশে এসে দাড়ায়। কবির কবিতা পড়তে পড়তে কবির অভিজ্ঞতা ছড়িয়ে পরে পাঠকদের মধ্যে। পাঠকের অভিজ্ঞতা আর অনুভবের গণ্ডি বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে। কবির লেখা গুলোর মধ্যে ছোট ছোট লেখা অনেক, যেগুলো ছোট হয়েও ভাব ও বিস্তারের অনন্য সত্য ও উপলব্ধি নিয়ে দাড়িয়ে। তাই কবির কবিতার লাইনেই বলা যায়
ছোট ছোট বাক্যে শেষ হয়ে এলো
বাংলার নতুন কবিতা।
কবির মুক্তি বোধহয় এরকমই
ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং আকস্মিক


কাব্যগ্রন্থ ঃ নির্বাচিত ১০০ কবিতা, স্বনির্বাচিত কবিতা, মাটি ও মৃত্তিকা কালো দুটি বোন, ধানপাতা পানপাতা, আরও অনেক।


সাপিনীর সঙ্গে -- শ্যামলকান্তি দাশ


একটা আধমরা সাপিনীর সঙ্গে
আমার মিলন চলছে।
আমার উত্তুঙ্গ ফনায় দশদিক ঢেকে যাচ্ছে।
বাবা রে মা রে করেছে কত মানুষ --
অনেকক্ষণ ধরে মিলনদৃশ্য দেখবার পর
ছোটভাই বরভাইকে বললঃ দূর দূর, সাদাকালো ছবির
এই এক ঝামেলা,
বাস্তবতা একদম ফুটে ওঠে না।


খাই খাই -- শ্যামলকান্তি দাশ


তুমি আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছ, আর
আমি খুব সুখ পাচ্ছি।
আমার নাড়িভুঁড়ি দেহ ছাড়িয়ে আকাশে উঠে গেছে।
তোমার খাই খাই দেখে খুব পুলক হচ্ছে,
আরামে আমার চোখ সরু হয়ে আসছে।


মাথায় দমাদ্দম বাজ পড়ছে,
ঝলসাপোড়া শরীরে,
আর আমার কোন অগ্নিভয় নেই!


ফুটবল --  শ্যামলকান্তি দাশ


আমাকে কেউ আজ খেলতে নেয়নি,
খালি হাতে আমি সংসারে ফিরে যাচ্ছি।
অত বড় মাঠে ফুতবলের কান্না
আর চোখে দেখা যায় না।
ফুতবলের ধুসর অশ্রু আমাকেও
বৃষ্টির মধ্যে ছুঁয়ে যাচ্ছে।


সন্দেহ -- শ্যামলকান্তি দাশ


সন্দেহের বশে ক-বাবু মরে গেলেন।
সন্দেহের জ্বালায় ঘামাচির মতো
চিড়বিড় করতে লাগলেন খ-বাবু।
গ-বাবুর জীবনে সন্দেহি কাল হল,
সুদখোর মহাজনকে একবার তিনি সাপ ভাবলেন,
একবার রজ্জু।
তারপর সেই যে কালসিন্ধুজলে ডুব দিলেন,
আর উঠলেন না।


কেউ সন্দেহের উরধে নয় -- বলতে বলতে
আমি সন্দেহতীত আনন্দে বিলীন হয়ে গেলাম।


কুকুর -- শ্যামলকান্তি দাশ


আর যে বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতা নেই
একথা কুকুরও বুঝতে পেরেছে।
এবং বুঝতে প্রেছে বলেই
সে আমাকে সকাল থেকে
ছোট-বড় কথা বলছে ,
তুই তোকারি করছে।


অপমানের জ্বালায় আমার বিকট
আনন্দ হচ্ছে।
আমি নীরবে কাঁদছি, আর
কুকুরের লেহ ধরে দৌড়ে যাচ্ছি অনেকখানি, মছলন্দপুর!


বিস্ফোরণ -- শ্যামলকান্তি দাশ


কিছু কিছু দেখা বেশ মনে পড়ে।
শ্যমলের দেখা।
মেঘের সমান হাঁড়ি। হাঁড়ির সমান মেঘ।
বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণ।
কীসব বরফঢাকা সাদা দিন --
শ্যমলের হাত উড়ে গেল।


দুধ -- শ্যামলকান্তি দাশ


বুকের দুধারে কোনো স্তন নেই।
দুধ নেই।
মাতৃকার কুচোকাচা নেই।
রসের হিরন হাঁড়ি।
সারাদিন হাড়হিম। পাথর পাথর।


লোক -- শ্যামলকান্তি দাশ


আমি একটা লম্বা লোক, দজ্জাল মানুষ।
এখনও সায়ংকালে বেশি খাই। কম খাই।
পেট ফুলে ওঠে।
মা আমি লম্বা লোক, আট দশ বাইশ তেতিরিশ --
বেরাতে এলাম আর জলাশয়ে মাথা ঠুকে গেলো।


ডাইনোসরের অমর কাহিনি --  শ্যামলকান্তি দাশ ( কয়েক লাইন)


তিমিমাছের চোয়াল আর বাইসনের
ফাঁপা হাড়ের মধ্যে দিয়ে
হাজার–হাজার ছায়াপথ মিলিয়ে যাচ্ছে
ডাইনোসরের চোয়াল নাড়িভুঁড়ি আর হৃদয় মিলিয়ে তৈরি
একটা প্রকাণ্ড মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা হাঁ হয়ে যাই
আমাদের সরু চোখে
বিদ্যুৎরশ্মি ঝাপটা মারতে থাকে
অনবরত, অবিশ্রাম—ডাইনোসরের অমর কাহিনি লিখতে লিখতে
আমাদের চোখ জলে ভরে আসে


শ্রাবণ --  শ্যামলকান্তি দাশ ( কয়েক লাইন)


আজ বৃষ্টির দিন। আজ শ্রাবণ।
তা হোক। আমারা জানালায় থাকব।
আজ আমাদের ময়ূর। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ।
আজ আমাদের চলাচল।
.
.
.
ওগো জলের রানী, ওগো শ্যামলতা, তুমি আমাদের
চলাচল থেকে উদ্ধার করো। ময়ূর থেকে বাঁচাও।


নদীর নামটি রঞ্জনা -- শ্যামলকান্তি দাশ ( কয়েক লাইন)


নদীর নাম রঞ্জনা। জলে একটুও স্রোত নেই।
কিন্তু অনেক অনেক পাতা ভাসছে। অনেক অনেক খড়।
ভাসছে চাঁদমালা আর শোলা।
দড়ি ভাসছে আর রাংতা কাগজ।
শয়ে শয়ে জাল ফেললও নদী থেকে
একটাও মাছ ওঠে না।
.
.
.


ও আমার দেশের মাটি -- শ্যামলকান্তি দাশ ( কয়েক লাইন)


কাঁটাতারের বেরা পেরালেই
টানা, লম্বা একটা দেওয়াল


দেওয়াল পেরলেই ধোঁয়া --


.
.
.
তবুও, ও আমার দেশের মাটি,
পঞ্চাশ বছর আমারা কেউ কারও
মুখ দেখতে পাইনা!


রাজার কুমার -- -- শ্যামলকান্তি দাশ ( কয়েক লাইন)


মাটি ফুঁড়ে চুপিচুপি একাই বেরিয়ে এলাম একদিন
সারাগায়ে একটা চোর চোর ভাব
ঠিক ধরেছো, আমাকে একটা ব্যাঙের মতো দেখাচ্ছে।
.
.
.
সাপের খোলস ছেড়ে
আমি যেই ইশকুল মাস্টারের ছলের ওপরে উঠে এলাম
চোখে খুলে অমনি চেঁচিয়ে উঠলে
কোন পাশনাকায়ায় তুমি এতদিন বন্দি ছিলে কুমার?
এসো, এসো, ঘরে এসো।


মুদ্রারাক্ষস -- শ্যামলকান্তি দাশ ( কয়েক লাইন)


মুদ্রা নিয়ে খেলতেন বলে আমরা তাঁর
নাম দিয়েছিলাম মুদ্রারাক্ষস—
একদিন রাত্রিবেলা দেখি
মোহরের কলসি থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে  


রাক্ষসের প্রতিভা দেখে আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম!


আমার মা -- শ্যামলকান্তি দাশ


আমাদের ভাঙা দরজা পাহারা দেয়
গ্রহ-উপগ্রহ।


বাবা রাত জেগে আকাশের লেখা পড়ে


সওদাগরের মেয়ে আমার মা, এখন বনে বনে
ঘাসপাতা কুড়োয়।


কুড়নো ঘাসপাতায় আগুন রচনা করে
আমাদের জনমদুখী ভাই
ক্ষুদিরাম।


আর সেই আগুনে জ্বলে-পুড়ে সোনা হয়ে ওঠে
আমার হতভাগিনী দিদি
অপরূপা।


রাত শেষ হওয়ার আগে আমাদের এই হবিবপুর গ্রামে
শূন্য থেকে উড়ে আসেন
সুন্দর।


তখন আমাদের এই মেঘমেদুর কুটির
চাঁদের আলোয় ভেসে যায়।


তথাস্তু -- শ্যামলকান্তি দাশ


বনের বাঘ, পথ ভুল করে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছি,
একটু হালুম হুলুম না করলে চলে ?
এইটুকুই তো বাঘের অলঙ্কার !
মনের দুঃখে আজ সারাদিন ঝাঁপাঝাঁপি করলাম,
হুঙ্কার দিলাম । কেউ ঘুরেও দেখল না ।


অঞ্চলপ্রধান বদ রাগী মানুষ
পেটে লাথ মারলেও এক ছটাক বিদ্যে বেরোবে না ।
তিনি আমাকে ঘাস পাতার পাহাড় দেখিয়ে বললেন :
যান, খেয়ে নিন,
বেশি চেঁচালে জিভ ছিঁড়ে ফেলব কিন্তু !


তাঁবুর ভেতর থেকে তাঁকে একবার
জুলজুলে চোখে নিরীক্ষণ করলাম,
তারপর অস্ফুট শব্দে বললাম : তথাস্তু !


বৃষ্টি -- শ্যামলকান্তি দাশ


দিনভর লম্বা লম্বা বৃষ্টি।
সেনবাড়ির মেয়েরা কেউ বাইরে বেরোতে পারছে না।
কী জ্বালাতন বলুন তো!
পেঁপেগাছের তলায় ভিজছে গুল্ম, আর
লম্বা লম্বা লোকজন।

ছোট ছোট বাক্যে শেষ হয়ে এল
বাংলার নতুন কবিতা।
কবির মুক্তি বোধহয় এরকমই।
ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং আকস্মিক।

দু’চোখ ভরে বৃষ্টির খেলা দেখছে
লম্বমান শহরতলি।
তুমি খানিকটা হতভম্ব,
আমি কে বলো তো, সুবর্ণলতা?  


কয়েক টুকরো রূপকথা -- শ্যামলকান্তি দাশ ( কয়েক লাইন)


ফুল দিয়ে বাহার দিয়ে বালি র কাঁকর দিয়ে প্রাকার পরিখা দিয়ে
সাজানো হয়েছে ছোট একাটা দেশ,
যাতে তারকাটার বেড়ার পাশে ঘরবাড়ি সতেজ হয়ে ওঠে,
যাতে উঠোন বারান্দা ফুল্ল দেখায়, আর রাত্রিবেলা
নদীর জলে তরঙ্গের পাশে দরজা জানালার ছায়া পড়ে,
ক্ষুদ্র -- অতি ক্ষুদ্র ঘুলঘুলিও যেন রাজার পুকুরে
লালকমল নীলকমলের সঙ্গে কল কল কথা বলতে পারে!
.
.
.


পথভোলা -- শ্যামলকান্তি দাশ


দিকে দিকে তোমার শতেক পথ,
আমবনে জামবনে,
কাঁঠালছায়ায়।
রসে ভরা অঢেল সুচারু ফল,
কাগা খায় বগা খায়,
পোলাপান খায়।
তোমার প্রতিটি পাতা একরোখা,
ঢেউ তোলা ফুসে ওঠা,
অনুমানে চিনি।
ঢুকেছি নিজের মতো নিরিবিলি,
কোথাকার পথভোলা --
বেরোতে পারিনি!


বাড়ি -- শ্যামলকান্তি দাশ (কিছু লাইন)


নৌকা থেকে নেমে আর মাত্র দুপা এগালেই বাড়ি


বাড়ির ভেতর প্রকাণ্ড মাঠ
শয়ে শয়ে লোক ফুটবল খেলছে
কোথাও কোনো হাততালির শব্দ নেই
রিনরিন করছে শুধু একটা মূর্ছনা
.
.
.


কান্না দিয়ে লেখা -- শ্যামলকান্তি দাশ (কিছু লাইন)


আমি যেদিন মারা গেলাম, সেদিনের কথা
খুব মনে পড়ছে।


আমার চোয়াড়ে, হতকুচ্ছিত, ধুমসো শরীরের দিকে তাকিয়ে
পিশাচীর মতো তুমি অনেকক্ষণ ধরে
হাউমাউ করে কাঁদলে।
হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদলে।
গলা ফুলিয়ে কাঁদলে।
.
.
.


মুখ -- শ্যামলকান্তি দাশ (কিছু লাইন)


পঁচিশ বছর আমাদের মুখ-দেখাদেখি বন্ধ
এতদিন সব রসের কুণ্ড বাষ্প হয়ে গেছে
যৌনতার দীঘল সরবোর শুকিয়ে খটখটে
বুকে জমেছে থলথলে মাংস
.
.
.


চাঁদের রক্ত -- শ্যামলকান্তি দাশ (কিছু লাইন)


চাদকে আমারা হত্যা করেতে যাচ্ছি
চাঁদের রক্ত খুব বেশি দূরে নয় আর।


গাছের তলায় ভিখারি ছেলের জটলা
তারাও বলেছে চাঁদ নাকি শ্রেনিশ্ত্রু।


.
.
.


তথ্যসূত্র ঃ  ইন্টারনেট, কবির লেখা বই, ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকা।
( কবির সাথে আরো পরিচিত হতে কবিতার বই কিনুন ও পাঠক হোন )