ফিরোজা -কমল-নজরুল এই তিন ত্রয়ীর পরস্পরের প্রতি আবেগ–‌দুর্বলতা–‌আসক্তির স্বমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে বাংলার সংগীত জগতের এক অধ্যায়। এ শুধু নজরুল গীতি নয়, আমি বলি বাঙালির মনের গীতি। রবীন্দ্রসংগীতে আছে বাঙালির প্রাণ আর নজরুল গীতিতে আছে বাঙালির মন।  


নজরুল- জন্ম: ২৫ মে , ১৮৯৯ , মৃত্যু - ২৯ অগাস্ট ১৯৭৬
কমল দাশগুপ্ত - জন্ম : ২৮ জুলাই, ১৯১২ - মৃত্যু : ২০ জুলাই, ১৯৭৪)
ফিরোজা বেগম- জন্ম: ২৮ জুলাই ১৯৩০– মৃত্যু: ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪)


একটু হিসেবটা করে নিই আগে। এতএব নজরুল থেকে কমল ১৪ বছরের ছোট। আর ফিরোজা বেগম কমলের থেকে ১৮ বছরের ছোট।নজরুলের থেকে ফিরোজার বয়সের তফাৎ ঠিক ৩২ বছরের।
এবারে আসি কাজের কথায়। প্রথম সাক্ষাৎ হলো কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে। একটা মিষ্টি গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। ফিরোজার কোনো গানের টিচার ছিলোনা। গান শোনার খুব শখ ছিল।রেডিওতে গান শুনতেন আর গানগুলো লিখে নিজে নিজেই গাইতেন। ধরুন ফিরোজার বয়স তখন প্রায় ১২? ভাই আর মামা মিলে ওনাকে খুব উৎসাহ দিলেন।বললেন চল তোকে  এইচএমভিতে অডিশনের জন্যে নিয়ে যাবো। যে কথা সেই কাজ।
ফিরোজা তো বেশ নার্ভাস। ঐটুকুন একটা মেয়ে কে নিয়ে মামা নিয়ে গেলেন সেই কলকাতার দমদমের বিখ্যাত এইচএমভিতে। সেখানে রিহার্সেল রুমে ঢুকে দেখলেন ঘর ভর্তি লোক। তারই মাঝে একজন ঘিয়ে রঙের পাজামা -পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি,চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা পড়া একজন লোক বসে আছেন। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে ওই ভদ্রলোক বললেন 'এস মা আমার পাশে এখানে বসো।' 'তা কি ব্যাপার এখানে কেন?' ফিরোজা - 'অডিশন দিতে এসেছি'। শুনে তিনি তো হো হো করে হেসে উঠলেন।  "বাহ্ বেশ তো, তা কি গান শোনাবে আমাদের" ? ফিরোজা উত্তরে বললেন "আমি গাইবো 'যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা, শুধু চোখের দেখা দিতে এসোনা"। গানটি খুব কঠিন ছিল। গান শেষ করেই ফিরোজা ওঠে দাঁড়ালেন, ফিরে যাবার জন্যে প্রস্তুত। আমাকে উনি হাত টেনে ধরে বসালেন। বললেন, 'ওরে সর্বনাশ! এ কী গান শোনালে তুমি। এতটুকু মেয়ে এ গান কীভাবে, কোথা থেকে শিখলে?' ফিরোজা:,-'কারও কাছ থেকে নয়। বাড়িতে কালো মোটা ভাঙা ভাঙা রেকর্ডগুলো আছে না, ওইগুলো শুনে শুনেই শিখেছি।' উনি আবারও হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর তিনি ফিরোজার বাবা-মা, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। এরপর বললেন, 'এত কঠিন গান তুমি একা একা তুলেছ। বলো কী, এত মিষ্টি কণ্ঠে মাত্র একটা গান শুনে কি ছাড়া যায়? আমরা কি আরেকটা শুনতে পারি না?' ফিরোজা:- 'তার কথায় আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি আর বিরক্ত লাগছিল। মাথা নেড়ে বললাম, 'না'। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি হারমোনিয়াম বাজাতে পারি কিনা? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। একটা হারমোনিয়াম টেনে আমার সামনে দিলেন। আমি দ্বিতীয় গান ধরলাম, 'কালো পাখিটা মোরে কেন করে এত জ্বালাতন'। ডি এল রায়ের এ গানের মধ্যে সূক্ষ্ম কারুকাজ ছিল অল্প বয়সীদের কণ্ঠে সেটা আসে না। গানটির অর্ধেক ফিরোজা বললেন , 'আর গাইতে পারব না'। কাজী নজরুল ইসলাম বললেন, 'ঠিক আছে, যা গেয়েছ তাতেই আমরা অবাক। তবে বলে যাও, আবার আমাকে গান শোনাতে আসবে?' ফিরোজা তখনো পর্যন্ত্য জানেন না যে উনি স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম।মামা বললেন তুই যার পাশে বসে আছিস উনিই কাজী নজরুল ইসলাম।কাজী একজনকে ডেকে আনলেন আমার কাছে। খুব সুদর্শন পুরুষ। আমার সঙ্গে তাঁর আলাপ করে দিলেন কবি নিজে। এই সুদর্শন পুরুষটি হলেন কমল দাসগুপ্ত।
এ গেলো প্রথম পর্যায়ের আলাপ পরিচয় এই তিন সহজাত সৃজনী ক্ষমতা'র তিন ত্রয়ীর।
এবারে আসি আমার গল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে:-


কাজী নজরুল গ্রামাফোন কোম্পানি তে কম্পোজার হিসেবে যোগ দিলেন এবং কমল দাসগুপ্ত নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন ১৯৩৪সালে। তখন আরাম্ভ হয়েছে সবে নজরুল গীতির প্রচলন। ক্রমে ক্রমে নজরুলগীতির ভাষা,
ভাব ও স্টাইল চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু হয়েছে।গৃহস্ত ঘরের মেয়েরা নজরুল গীতি তে আকৃষ্ট হতে লাগলো।
কমল দাসগুপ্ত ছিলেন নজরুল গীতির ট্রেনার অর্থাৎ কবির কাছে গান শিখে ট্রেনিং দিতেন শিল্পীদের। একটা কথা যে কাজী নজরুল সাধারণত গান রচনার পূর্বে একটা সুর ঠিক করে নিতেন ও তাতে বাণী বসিয়ে নিতেন। তাই নজরুল গীতিতে সুর ও বাণী অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নজরুল তাঁর গান তাঁর দেয়া সুরে না গাওয়া হলে বিরক্ত হতেন।
কিন্তু রিহার্সালের সময় পরিস্থিতি এমন দাঁড়াতো যে দেখা যেত গানের কমার্শিয়াল ভেল্যু কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে । এই রকম পরিস্থিতিতে কমলের উপস্থিত বুদ্ধি সুর ও কবির সুরের মধ্যে তারতম্য ঘটিয়ে গানের ভাব মূর্তিকে আরো ফুটিয়ে তুলতেন।তাই কবিও আর বিশেষ আপত্তি করতেন না। উদাহরণ: "না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা" গানটি রচনাকালে কবি যে সুর দিয়েছিলেন রেকর্ড বেরোনোর পরে দেখা গেলো যে সুরটির কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে একটু চটুল ভঙ্গিতে গাওয়া হয়েছে। কান্ডটা কমল ই ঘটিয়েছিলেন গানটির কমার্শিয়াল ভেল্যু বারবার জন্যে। এইভাবে নজরুলের অনেক গানেই কমলের নিজস্ব সুরের ছাপ আছে কিন্তু তাতে গানগুলি আরো শ্রুতিমধুর ও হয়েছে। এভাবেই নজরুল ও কমলের মধ্যে গড়ে উঠেছিল পরম্পর বোঝাপড়ার দ্বারা এক বোধশক্তি।
আমার গল্পের তৃতীয় পর্যায়ে আমি আবার আনছি ফিরোজা ও নজরুলকে।


ফিরোজা বেগমের নিজের মুখে কিছু গল্পকথা শোনা যাক, যেগুলো উনি উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।


"কয়েক মাস পর আবারও কাজী নজরুল ইসলামের কাছে যাই। তিনি বললেন, 'তোমার ওই গানটা আবার শোনাও তো! যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা/শুধু চোখে দেখা দিতে এসো না।' এক সময় তো কবি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কবি সুস্থ থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। অসুস্থ হওয়ার পরও কবিকে দেখতে গিয়েছি। তার প্রতিটি জন্মদিনে আমরা যেতাম। তার অসুস্থ অবস্থায়, 'দৃষ্টিতে আর হয় না সৃষ্টি আগের মতো গোলাপ ফুল' গানটি তাকে গেয়ে শুনিয়েছিলাম।"


"ভালো গান শেখার ইচ্ছাতেই এক দিন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী চিত্ত রায়কে বলে বসলাম, গান শিখতে চাই আমি। শুনে তো তিনি অবাক। কী বলে এ মেয়ে? সেই থেকে শুরু হলো সংগীতের তালিম। একদিকে চিত্ত রায় অন্যদিকে কমল দাশগুপ্ত। মহান এই দুই শিল্পীর কাছে আমি ঋণী। বিশেষত কমল দাশগুপ্তের কাছে। তার কাছে আমি সব ধরনের গান শিখেছি। আমার জীবনের মূল শিক্ষাটাই তো পেয়েছি কমল দাশগুপ্তের কাছে।"


"কমল দাশগুপ্ত ছিলেন নজরুলের পরম বন্ধু।  যার সাথে কাজী নজরুল ইসলাম তার রচিত গান নিয়ে পরিকল্পনা, চিন্তা-ভাবনা এমনকি সুর ভাঙা-গড়া ইত্যাদি সব বিষয়েই আলোচনা করতেন। সেই কমল দাশগুপ্তের কাছ থেকেও অনেক কিছু জেনেছি নজরুল সম্পর্কে।
ফিরোজার কবিকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণ :-


কবির সঙ্গে তাঁর অনেক আনন্দ-বেদনা জড়িয়ে ছিল জীবনে।
ফিরোজা কি বলেন এ ব্যাপারে শোনা যাক:-
নানা কারণে শেষ দিকে তিনি প্রায় বিমর্ষ থাকতেন। আমি ও কমল যখন তার ঘরে আসতাম-যেতাম তখন তিনি আমার ও কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কাজী সাহেবকে কমল দাশগুপ্ত প্রায়ই বলতেন, ‘কী কাজীদা  চিনতে পারেন? তখন আবার আমার মুখের দিকে চোখ মেলে তাকাতেন এবং কী যেন বলতে চাইতেন। আমার মনে হলো তিনি একটু উত্তেজিত। কিছু একটা আমাকে বলতে চাইছেন। কলকাতায় থাকাকালে এ রকম প্রায় হতো, তখন প্রমীলা নজরুল আমাকে বলতেন, তিনি অশান্ত হয়ে উঠেছেন, তুমি বরঞ্চ তাকে একটি গান শোনাও। তখন হারমোনিয়াম আনতে বলা হতো। এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে যে দরজার দিয়ে হারমোনিয়াম আনা হয়, ওদিকে কাজী সাহেব তাকিয়ে থাকতেন আর কী যেন খুঁজতেন। হারমোনিয়ামটা যেই আসত, তখন তিনি হেসে ফেলতেন। হারমোনিয়াম আনার পর তিনি নিজে কাছে এসে হারমোনিয়ামটা টেনে নিলেন। তখন আমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে। আমাকে অভয় দিয়ে তখন প্রমীলা নজরুল বললেন, ‘তুমি তাড়াতাড়ি গান কর, দেখবে তিনি শান্ত হয়ে যাবেন।’ তখন আমি গান করলাম এবং তারপর কমল বাবুও গান গাইলেন। তিনি খুব শান্ত-সুন্দরভাবে শুনলেন। তারপর খাট থেকে নেমে এসে আমার পাশে বসে ডান কাঁধে হাত রাখলেন। আর যদি তার কোনো দুঃখের গান গাইতাম, তাহলে কেঁদে ফেলতেন। একদিন আমি যখন গাইলাম- ‘মুসাফির মোছরে আঁখি জল…’, তখন দেখলাম তার দু’চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছে, তিনি আমার হাত ধরে আছেন, আর আমার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।


আমার গল্পের শেষ পর্যায় :-


সংগীতে কমল দাসগুপ্ত এক বিরল প্রতিভাবান মানুষ। নিভৃত নিরালায় তিনি নিরলস সাধনা করে গেছেন আর সৃষ্টি করে গেছেন নতুন নতুন সুর।১৯৩৪ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত্য নজরুলের সঙ্গে তাঁর সুরের মায়াজাল বোনা। তাই সংগীতের এই কিংবদন্তির সঙ্গে একমাত্র তাঁর নিজেরই তুলনা চলে।


১৯৫৫ সালে ফিরোজা ও কমল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। একসময়ে খুব অর্থনৈতিক কষ্টে তাদের দিন কেটেছে। এমনকি কমলকে শেষে এক মুদিখানা খুলতে হয়। শেষের দিকে তিনি কিছুটা নেশাসক্ত হয়ে যান।
১৯৭১সালে দেশ স্বাধীন হলো।কমলের পরিকল্পনাতে বেতার কেন্দ্রে সৃষ্টি হলো 'ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস'।সহধর্মিনী ও তাঁর প্রিয়তমা ফিরোজার নাম দিয়ে "নজরুল গীতিমালা' নামে বাংলা একাডেমি থেকে স্বরলিপি প্রকাশ করতে থাকেন। স্বরলিপির সাংকেতিক চিহ্ন ও তার কলা-কৌশল সবই কমল দাসগুপ্তের নিজের উদ্ভাবন ছিল !


উপসংহার:-
এক স্বয়ম্ভর সংগীতসভার সৃষ্টি হলো এই তিনজনকে নিয়ে ।


টিকা :
ফিরোজা-কমল-নজরুল
দোলনচাঁপা আর পদ্মফুল

ঋণ স্বীকার :-
৬০-৭০ দশকে এইচ এম ভি থেকে প্রকাশিত "রেকর্ড সংগীতের' পুরোনো সংখ্যা(নিজস্ব সংগৃহিত)
https://www.bd-pratidin.com/
https://sarabangla.net/
http://www.bongodorshon.com/