অকাল বিসর্জন
—উৎপল নরেন্দ্র মাইতি


পুজো আসতে বেশি দেরি নেই আর।
শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে চারিদিক সুবাসিত !
আকাশে বাতাসে ভেসে আসছে মায়ের আগমনী বার্তা।
মন্ডপে মন্ডপে দ্যাখা যাচ্ছে শেষ মুহূর্তের ভীষণ ব্যস্ততা।
বর্ষায় ভেঙেছে রাস্তা, মেরামতি চলছে খুবই তৎপরতার সাথে।


পুজো মন্ডপ আমাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় ;
ঐ তো যেখানে শনি-মঙ্গলবার সকালে হাট বসে ।
মাঝে শুধু একটু জঙ্গল ঘেরা রাস্তা ;
গ্রাম তো তাই নেই কোনো আলোর ব্যবস্থা।
দিনের বেলা ভয় করে না,  তবে...
একটু গা ছমছম করে শুধু যখন সন্ধ্যা হয় !


একটু একটু করে কতো কিছু ভেবে রেখেছি !
পুজো এলে মেলায় যাবো, কাঁচের চুড়ি কিনবো, আরো কতো কি !
তবে নাগরদোলায় আমার বড্ড ভয় !
আমি কিন্তু চড়ি না কেউ দিলেও অভয় !


এখন আমি ইলেভেন, আর ও সেকেন্ড ইয়ার।
ও কে ? সে আছে একজন !  দ্যাখা-সাক্ষাৎ কথা-বার্তা কমই হয় ;
শেষবার দ্যাখা হয়েছিল মাস দুয়েক আগে।
এতদিন পর আবার হবে দ্যাখা এই দুর্গাষষ্ঠীতে !
হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছে সে,
দিন গুনে গুনে এই অপেক্ষাতেই আছি কবে পড়বে পূজোর ছুটি !


এতদিন পর অপেক্ষার হল অবসান,  
আজ সেই বহু কাঙ্খিত দুর্গাষষ্ঠী !
পরিপাটি সাজগোজ করে বিকেল বিকেল পড়েছি বেরিয়ে।
ও এসেছে কমলা পান্জাবীতে ,
আমি পরেছি হলদে ফুল আঁকা নীল রঙের শাড়ী।


এর আগেও তো অনেকবার দ্যাখা হয়েছে, কথাও হয়েছে কতো ;
তবে এবারটা যেন একেবারে অন্যরকম !
পরনে নতুন জামাকাপড় তার সাথে পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ
হৃদয়কে যেন আন্দোলিত করেছিল !
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জন দু’জনার গা ছুঁয়ে
প্রতিমা দর্শন করছিলাম হাতদুটি জড়ো করে !
আমার যেন তখনও বিশ্বাসই হচ্ছিল না !
সবটাই মনে হচ্ছিল যেন মধুর স্বপ্ন !


যে আমি নাগরদোলা চড়তে এতো ভয় পাই
ওর অনুরোধ কিছুতেই পারলাম না ফেলতে।
নাগরদোলা ঘুরতে শুরু করলো !
ভয় পেয়েছি বুঝতে পেরে ও আমায় আগলে রাখলো !
এই প্রথম ও আমায় জড়িয়ে ধরলো !  
ওর হাতের ছোঁয়ায় যেন শিহরিত হলাম !


মেলায় আমরা কতো ঘুরলাম।
আইসক্রীম খেলাম, ভেলপুরী আরো কতো কি !
ও আমায় কিনে দিল রঙ-বেরঙের একগাছা কাঁচের চুড়ি।
এতো বড় মেলায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে আট টা পেরিয়ে গেছে
বুঝতেও পারিনি।
এই প্রথমবার এতোটা সময় আমরা একসাথে কাটালাম !
অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাঁটা লাগালাম বাড়ির পথে।
ও সাথে এলো আমায় এগিয়ে দিতে।
রাস্তা ঠিকমতো দ্যাখাই যাচ্ছিল না, ঘুটঘুটে অন্ধকার !
পাশাপাশি দুজনে হাঁটছিলাম একে অপরের হাতটি ধরে।


ও আমায় জিজ্ঞাসা করলো... “বাড়ি আর কতো দূরে” ?
আমি বললাম...
     “বেশি নয় আর, কাছাকাছি, পৌঁছে যাবো ;
     ঐ তো সামনের মোড়টা পেরোলেই”।


দেরী হয়েছে, তাই আমরা হাঁটছিলাম একটু তাড়াতাড়ি করেই।
মোড়ের সামনে পৌঁছতেই...হঠাৎ কে যেন মারলো ওর মাথায় সজোরে !  
লুটিয়ে পড়লো মাটিতে !  মুখটা চেপে জাপটে ধরে
নিয়ে গেল আমায় জঙ্গলে টেনে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে !
হাত মুখ বাঁধলো শক্ত করে !  
আবছা আলোয় দেখলাম ওদের লোলুপ দৃষ্টি !
হায়নার মতো জিভ যেন লকলক করছে !
যেন কতদিন অভুক্ত রয়েছে !  এক্ষুনি ছিঁড়ে খুবলে খাবে !


অনেক চেষ্টা করলাম নিজেকে বাঁচাতে !
এতগুলো পশুর মাঝে আমি যে একা !!
পারলাম না মহিষাসুর-মর্দিনী হতে !
ওদের পাশবিক অত্যাচারে জ্ঞান হারালাম !
রইলাম পড়ে অন্ধকারে ঘন জঙ্গলে !


মনে কতো স্বপ্নের জাল বুনেছিলাম !
এক মুহূর্তের দমকা হাওয়ায় সব শেষ !
আজ সেই কতো কাঙ্খিত দুর্গাষষ্ঠী !  আজ হলো মায়ের বোধন !
আর আজই হলো আমার...অকাল বিসর্জন !!  অকাল বিসর্জন !
                                   *****